লকডাউনের দিনলিপি

২৪ মার্চ কী অভিশপ্ত? 

সমীরণ নন্দী


সেদিন সকালে উঠে ভাবতেও পারিনি রাতে এক ঘোষণায় বদলে যাবে আমাদের প্রাত্যহিক দিনলিপি। ১৬ বছর আগের এক অভিশপ্ত ২৪-এর সকালেও ভাবতে পারিনি তছনচ হতে চলেছে সামনের কয়েক বছর, সেবারেও দুশ্চিন্তা আর উদ্‌বেগে কেটে যেত দিনগুলি। অবশ্য সেবার শান্তিনিকেতনের কিছু মুষ্টিমেও মানুষের জন্য ছিল সেই বিনিদ্র রাত গুলি। সেবার চুরি হয়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের 'নোবেল' পদক। তখন ছিল অন্য ভয়, এবার অন্য!
এক অজানা শব্দ 'করোনা' এখন লোকের মুখে মুখে, একটা ভাইরাস! প্রায় পৃথিবী সুদ্ধ মানুষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তার থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় ঘরে নিজেকে বন্দি করে ফেলা। সরকারি নির্দেশ বড় কড়া, বেরোনো যাবে না বাড়ি ছেড়ে। বাড়িতেই থাকতে হবে, নিজের জন্য, পড়শিদের জন্য, দেশের সবার জন্য। সকালের হাঁটা বিকেলের সান্ধ্য ভ্রমণ দুটোই বাদ। যদিও শান্তিনিকেতনে এত অল্প লোক এখানে বেরোলেও কিছু হয়তো হত না।
আমাদের পাড়াটার পরিধি বেশ বড়, লোক মাত্র ৮৩/৮৪ জন। তাই কন্টামিনেশনের ভয় খুব কম। যাই হোক বেরোচ্ছি না আর। আমার বাড়ির চারদিকেই গাছ, পাশের বাড়িগুলোতেও কেউ থাকে না, গাছপালাও প্রচুর আর তাই বাড়ির ছাদ থেকেই কিছু পাখি দেখা যায়। আমি প্রকৃতির কাছছাড়া থাকতে পারি না, ছবি না তুলে থাকতে পারি না। আমার বাড়ির ছাদ থেকেও যে এত পাখি দেখতে পাবো এত ছবি তুলতে পারবো আগে ভাবিনি। কত কত পাখির দেখা পাচ্ছি, যে পাখি দেখার জন্য এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতাম তার দেখা বাড়ির ছাদ থেকে।
'ফটিকজল' এমনই একটা পাখি। দুটি ফটিকজল পাখির ডাকাডাকি আর ব্যস্ততা দেখেই কেটে গেল একটা সকাল। কত কত পাখি আসে আমার বাড়ির পাশের গাছগুলোতে। বুলবুলি ছাতারে দুর্গা টুনটুনি টুনটুনি কাঠঠোকরা হাড়িচাঁচা ফিঙ্গে এরা সবাই মিলে যেন একটা কন্সার্ট বাজাতে থাকে। ছবি আর ভিডিও তুলেই সকাল কেটে যায়। নিজেকে ব্যস্ত রাখি। দুশ্চিন্তা না যেন গ্রাস করে।
আমি রোজ ভোর পৌনে পাঁচটায় উঠি, এ আমার বহুদিনের অভ্যেস। এখন বরং সাড়ে পাঁচটায় চা ক্যামেরা আর সিগারেট নিয়ে ছাদে চলে যাই। ওখানেই পায়চারি করি। সেদিন আকাশটা বড্ড চমৎকার ছিল, নীলের ক্যানভাসে একটু একটু মেঘের ছোঁয়া, প্রকৃতির কাছে সেদিন মাত্র দুটো রঙ ছিল আকাশ রাঙ্গাবার জন্য, ক্যানভাসটা নীল রঙে চুবিয়ে নিয়ে তুলিতে সাদা রঙ মাখিয়ে খুব হাল্কা টানে কিছু ছবি এঁকেছেন।  সেদিন তাই শুধুই আকাশের ছবিই তুললাম।  আকাশের রঙ বদলে গেছে, নীল আরও গাঢ় হয়েছে।পৃথিবী জুড়েই দূষণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছে এই ক'দিনেই। সেটাও একটা আশির্বাদ। সন্ধ্যায় বাড়ির ছাদে পায়চারি করছিলাম, সূর্য অস্ত গিয়েছে, দিগন্তে কমলা রঙের ছোঁয়া, দিগন্তের একটু উপরে চাঁদ আর সন্ধ্যাতার। আকাশের নীল আরও নিবিড় হচ্ছে আস্তে আস্তে। প্রকৃতি হয়তো তার কলুষ দূর করছে।
‘‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা ॥
বাজে অসীম নভোমাঝে অনাদি রব,
জাগে অগণ্য রবিচন্দ্রতারা ॥’’
পাখি আর প্রকৃতি-এ যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুঃসহ জীবনের ক্লান্তি, বিভীষিকাময় সব স্মৃতি, মনের অভিলাষ, অব্যক্ত ভাষা- সবকিছু ছাপিয়ে জীবন রাঙিয়ে তুলতেই প্রকৃতি আমাদের দান করেছে এই পাখি। পশ্চিমবঙ্গের এক গ্রামে আমার শৈশব কেটেছে। গ্রীষ্মের দখিণা বাতাসে আমের মুকুলের গন্ধে সুবাসিত হত চারপাশ। পাশের আম বাগান থেকে ঘুঘুর বিষণ্ণ ডাক কেমন জানি এক একাকিত্ব এনে দিত মনে। সেদিন সকাল থেকেই এটা হচ্ছিল,
জীবনানন্দের কথায়— "পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে; পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;’’
দুই জোড়া ঘুঘু ডেকেই চলেছে। ছাদের কার্নিশে এসে ঘুরেঘুরে, সামনে এসে অবহেলা ভরে ঘুরে তাকিয়ে চলে যাচ্ছে। শান্ত আর ধীর, যেন কোনও তাড়া নেই, বড়ই অলস আর মন্থর। অথচ এত নিরীহ শান্তশিষ্ট পাখিটার নামে কেন যে এত বদনাম! বাংলা প্রবাদে কত কথা! আপাততঃ কয়েকটা মনে পড়ছে— বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান/ এবার ঘুঘু তোমার বধিব পরান। আরও আছে. ঘুঘু দেখেছো, ফাঁদ দেখোনি। আরেকটা— লোকটা একটা আস্ত ঘুঘু। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘ভিটায় ঘুঘু চরানো’। আমাদের প্রকৃতিকে আমরা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছি, ক্ষতবিক্ষত করেছি  প্রকৃতি না এবার আমাদের ফাঁদ দেখিয়ে ছাড়ে, অথবা না ভিটেয় ঘুঘু ...!
তবে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সেই ঈশপের গল্পটাকে। ‘এক পিপড়ের খুব পিপাসা পেল। সে এলো নদীর পাড়ে জল খেতে। নদীতে ছিল স্রোত, সেই স্রোতে পিঁপড়ে জলে ভেসে গেল। গাছের ডালে ছিল একটি ঘুঘু। সে ভাবল, পিপড়ে টাকে বাঁচাতে হবে। সে একটা পাতা ফেলে দিল পিপড়েটার সামনে। পিপড়ে অনেক কষ্টে পাতার ওপরে উঠল। ঘুঘু পাতাটা ঠোঁটে তুলে ডাঙায় এনে রাখল। পিপড়ে প্রাণে বেচে গেল। সেদিন থেকে ঘুঘু হলো তার বন্ধু।’
মানুষের এই দুর্দিনে প্রকৃতি নিশ্চয়ই আমাদের বাঁচাবে। আমরা কাটিয়ে উঠব-ই এই সংকট।

ছবি : লেখক


     

Post a Comment

0 Comments