লকডাউনের দিনলিপি



গভীর রাতে একটা টেলিফোন আসছে     

দীপশেখর চক্রবর্তী 


গভীর রাতে একটা টেলিফোন আসছে বিগত চার পাঁচদিন ধরে।কোন কথা বলে না। কিছুক্ষণ পর নিঃশব্দে রিসিভার নামিয়ে রাখে।কয়েকটা ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ শুনি।
প্রতিদিন রাতের বেলা একটা টেলিফোনের অপেক্ষা থাকছে গৃহবন্দীদশার এই চার পাঁচদিন। সারাদিন ধরে কল্পনা করি এমন টেলিফোন কার?বন্ধু বা আত্মীয় নয়। এমন কেউ যার আর কোন কথা নেই আমাকে বলার। অথবা অসংখ্য কথা একটা সামান্য পথ দিয়ে আসতে দিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। হয়তো একটা ফেলে আসা সম্পর্ক।
একটি সম্পর্ক যখন ধীরে ধীরে নিভে যায় তখন ভেতরে ভেতরে তীব্র একটা কষ্ট হৃদপিণ্ডটা মুঠোয় চেপে ধরে। মনে হয় এই প্রাণটাকে একটা বিরাট চিৎকার করে ছড়িয়ে দিই সর্বত্র। অথচ অসহায়। বয়স একটা সংযম আনে অথচ সেখানেই তো শেষ নয়। যদি অপরের হাতে বন্দী হতাম তাহলে নিজের সঙ্গে এই লড়াইটা সহজ হত। এখন বন্দীদশা নিজের হাতেই। নিজের বন্যতার সঙ্গে সভ্যতার যুদ্ধটা সবসময় চলতে থাকে।
ঘরের আলনাটায় মায়ের শাড়িটা যে বসন্তের বাতাসের সঙ্গে দোলার ভাষায় গল্প করে,বাবার আলমারিটা থেকে দরকারের কাগজগুলো অবসর নিয়েছে বছর দুই হল, যে বইগুলো আমি পড়ে ফেলেছি অনেক বছর আগে মধ্যে কয়েকজন নিজের ভেতরের একটা পাতা উলটিয়ে নিজেকে পড়ে নেয় একেকদিন- আড়াল থেকে দেখি আমি। গভীর রাতে একটা টেলফোন আসে এবং তাকে আমি বলতে পারি না এখুনি তো সময় নতুন নিজের দিকে পুরোনো চোখে তাকানোর।
বাইরের জীবনের সঙ্গে এই বিচ্ছেদ খুলে দিয়েছে একটা জানলা। তবে এই বন্দীদশা আজকের নয়। এই সমস্ত সহজ পাওয়া জটিলতার মধ্যে বন্দী হয়ে আছে কত সময় গেল। আমাদের সকল শৈশবের গান কতদিন নানা ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে মাথা নীচু করে আছে। দশ কুড়িটা বছর দ্রুত কেটে গেলো, যে আসার কথা ছিল রূপকথা নিয়ে সে কখনও এলো না। তিন সপ্তাহের পর হয়ত জীবন ছুটে যাবে আরও দ্রুত।নিঃসঙ্গতা কাটবে? তফাৎ কী?
এসব ভাবনার মাঝে ছাদে নিজেকে মুক্তি দিই। চারিদিকে এক শ্মশানের নিস্তব্ধতা। নেমে এসেছে প্রাচীন প্রেতেরা আমাদের শহরে। তাদের চোখেমুখে আশ্চর্য বিষণ্ণতা। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কোন বাড়িতে একান্তে গলা সাধতে বসেছে কোন কিশোরী মেয়ে।
নিজের বাড়িতে অপরিচিত আমি। কয়েকটা কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলার পর আশ্চর্য শূন্যতা। দূরত্ব আসলে সম্পর্কের স্বাভাবিকতা বজায় রাখে। প্রতিদিন সকালে বাতিল কাগজপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করে বাবা। মা টেলিভিশনে মৃত্যুর এগিয়ে আসার খবর পেয়ে চুপি চুপি হাত সেঁকে নেয় উনুনের আগুনে।
হয়ত আমাদের বাড়িতে আর কোন টেলিফোন নেই। কবে গৃহত্যাগী হয়েছে খেয়ালই করিনি। তবু গভীর রাতে একটা টেলিফোন আসে। সমস্ত শরীরকে অস্থির করে বাজে সে। প্রথমে অস্থিরতায় শুধু জানতে চাইতাম তার পরিচয়। এখন নয়,শুধু বলে যাই। যার ঘর ফুরিয়েছে সে কীভাবে ঘরে থাকে? যার সম্পর্ক ফুরিয়েছে সে কীভাবে নিজেকে বন্দী করে রাখবে সম্পর্কে? একটা ছবি যা বহুদিন আগে কিছুটা এঁকে যেন চলে গেছিলাম কোথাও। আবার রঙ করতে ফিরে দেখি একটাও রঙ ধরছে না।
তাকে বলি, এইসব দিন দ্রুত কেটে গেলে অযত্ন করবো না। জীবনের জটিল পথ ছেড়ে রোদে পাতার ঝিরিঝিরি ছাওয়ার মতো সহজ হব। একটা ঘর হবে আবার,লাল মেঝে। সকলে বলার মতো অনেকটা কথা খুঁজে পাবো।
অন্ধকারে বসে থাকি নির্বাসনের টেলিফোন কানে নিয়ে। ঘন নিঃশ্বাস শোনা যায়। তারপর নিঃশব্দে রিসিভার নামিয়ে রাখা। ঘুমিয়ে পড়ি কালকের জন্য বরাদ্দ সমস্ত কাজের ভাবনা মাথায় রেখে। আরও একটা দিন কেটে যায় নিসঙ্গতায়।
একুশদিনের ভেতর একদিন রিসিভার নামিয়ে রাখবে না সে। আপন একটা গলার স্বর বিপরীত দিক থেকে ডেকে বলবে-শুনতে পাচ্ছো?
আমরা সবাই এই শোনার অপেক্ষায় এখন থেকে আশায় বুক বেঁধে থাকবো।

Post a Comment

4 Comments