লকডাউনের দিনলিপি

জানলার এপাশ থেকে

মৈনাক বিশ্বাস


ঘরবন্দি! ঘরের বাইরে অদৃশ্য শত্রু ওঁত পেতে। টিভি খুললেই শুধু নজরে আসছে ভোটের রেজাল্টের মত এক এক করে বাড়তে থাকা মৃত্যুর সংখ্যা। আতঙ্ক। ‘কালবেলা’-র অনিমেষ যেমন নিজের পায়ের উপর বুলেটের ক্ষত দেখে আঁতকে উঠত, ঠিক তেমনই আমরা আজকাল জানলার বাইরের জনহীন রাস্তায় চেয়ে থাকি।
ছবি তুলতে বাইরে যাওয়া হয় না। ঘরের মধ্যে আলো খুঁজি, নয়ত পুরানো ছবি প্রসেস করি। বুঝতে পারি, আমাদের মন, কাজ— সবেতেই এক অন্যরকম ছবি, যেন একা হয়ে পড়ছি, সুকুরু তাজাকির মতো। বক্সার সেই জেলের ছোটো ছোটো কুঠুরিতে যেমন বন্দিরা থাকত, আমরাও যেন তাইই হয়ে পড়ছি।
শান্তিনিকেতনের ভোরের আকাশের নীল আজকাল খুব গাঢ়। আস্তে আস্তে একটা হলুদ আলো ছড়িয়ে পড়ে। কেমন করে যেন দিন বাড়তে থাকে, ছায়া এপাশ থেকে পাশে সরে সরে যায়। মুচকুন্দের ফুল শুকিয়ে ঝরে পড়ে ঘরের সামনে। বাড়িটা যেন মার্কেজের সেই গ্রাম মাকন্দ হয়ে ওঠে, শুধু কিছু পাপিয়া, কোকিল জিপসির দল হয়ে আসে।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে শুধু দু-তিনটে খবরের চ্যানেল ও কিছু বাংলা সিরিয়াল দেখার চ্যানেল হলেই হয়ে যায়, তার বেশি খরচ করা যায় না। কিন্তু তাতেও সময় কাটে না বাড়ির; তাই নতুন কিছু চ্যানেল যোগ করতে হয় রিচার্জ করে।
গরম পড়ছে। এই বিপদের সময় প্রতিদিন বাজার সম্ভব নয়, উচিত নয়। মোটা চালের ভাত ও কালো কলাইয়ের ডাল, আর হয়তো কোনও একটা হালকা তরকারি। মা-কে বলি বাগানের যেক’টা টম্যাটো ধরেছে, তা দিয়ে চাটনি করতে। মা বানিয়ে দেয়। আসলে, মা প্রতিদিনের মতই কোন এক অদৃশ্য শক্তিতে জেনে যায় যে আমার কখন খিদে পায়, যেটা আর কেউ জানে না। দুপুরের খাবার শেষে অল্প একটু ভাত রয়েই যায়। মা বাইরে বাগানে দিয়ে আসে সেই ভাত। কোথা থেকে একদল কাঠবেড়ালি, ছাতার পাখি এসে দুপুরের খাবার সারে। শীতের আমলকী রোদে শুকাই। সন্ধ্যায় দেখতে পাই আকাশ ভর্তি তারা! কিছুদিন আগেও ধুলো-ধোঁয়ামাখা আধা-শহরের গলির কোণে যেটুকু আকাশ দেখা যেত, তাতে আকাশ থাকত ঝাপসা। তারারা যেন অনেক কাছে এসে গেছে, যেমন ব্যস্ত বন্ধুরা আজ মেসেজের ইনবক্সে আড্ডা দেয়।
সবার মনের মাঝে ভয়। আর্নল্ডের সেই বিখ্যাত পঙক্তি ‘We mortal millions live alone’— বার বার ফিরে আসে। একা হয়ে পড়া। তবু আমরা আমাদের জন্য! নিজেদের জন্যই লড়তে হবে এই লড়াই। কিন্তু, একটাই প্রশ্ন ফিরে ফিরে আসেঃ একি তবে প্রকৃতির প্রতিশোধ? ঘোলাটে আকাশ কেটে গিয়ে তার নীল রং আজ পুকুরের জলে; পাখিরা ফিরে ফিরে আসে, শিষ কাটে; বাতাস আরও মিষ্টি পাতলা হয় — সবই কি তবে পৃথিবীর নিজ থেকে নিজেকে সুস্থ করার জন্য? হয়তো তাই!

ছবি : লেখক

Post a Comment

3 Comments

  1. বাহ্, খুব ভাল একটা লেখা। একটা চমৎকার সিরিজ শুরু হয়েছে।

    ReplyDelete
  2. bah,,👌👌 khub vlo likhe6is..likhe ja aro..💐

    ReplyDelete