মার্কিন মুলুকের ডায়রি




যেখানে স্বাধীনতা একটি স্থাপত্য বিশেষ। সেখানে গণতন্ত্র অবশ্যই এক স্তম্ভ। প্রকৃতির অপরূপ রূপ এবং মানুষের সহমর্মিতার এক নিদর্শন আমেরিকা। সেখানের দিন যাপনের আঁকিবুকি নিয়ে মার্কিন মুলুকের ডায়রি। লিখছেন বর্ষণজিৎ মজুমদার

আমেরিকায় এসে কিছু করে ফেলার অলীক স্বপ্নটা ছিল এক বোতলে পোরা তরল নেশা, গ্যাঁজাতে শুরু করেছিলো সেই আশির দশকের শেষ থেকে। সেই বোতলে শুধু পিঙ্ক ফ্লয়েড, জন লেনন, বব ডিলান-ই ছিলো না, ছিলো ডান্সেস উইথ দ উলভস আর ম্যাকানাস গোল্ডের দৃশ্যসম্ভারও। ততদিনে লেগে গ্যাছে কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দির থেকে জৈব রসায়নে পিএইচডির তকমা, নেশাটা তুঙ্গে। হ্যারল্ড ভারমুস আর মাইকেল ব্রাউনের স্টকহোমে নোবেল প্রাইজের মঞ্চে হেঁটে যাবার দৃশ্যটাও দেখে ফেলতাম চৌরঙ্গীর জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অন্ধকার এক ঘরে চেয়ারে ঢুলতে ঢুলতে। একটা চাকরি জুটিয়েছিলাম ওখানে। ১৯৯১, ইন্টারনেটের পদার্পন হয়নি, আমেরিকার দূরত্ব ভৌগোলিক দূরত্বের থেকেও অনেক দূর। অস্থায়ী একটি সামান্য ফেলোশীপে পোস্টডক্টরাল গবেষণা করার সুযোগের চিঠিটা সাথে করে নিয়ে এলো সাহস দেখানোরও সুযোগ। এক ছাপোষা সদ্য বিবাহিত যুবকের সরকারি চাকরির নিরাপত্তা হটিয়ে দেবার সুযোগ। জীবনে প্রথম প্লেনে চেপে হাজির হয়ে গেলাম উত্তর আমেরিকায়, এক বছর মিনিয়াপলিস শহরে কাটিয়ে চলে এলাম ওহাইও রাজ্যের ক্লিভল্যান্ড শহরে। কাজের জায়গা খুঁজে নিলাম জগৎ বিখ্যাত ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক ফাউন্ডেশনের গবেষণাগারে। আজকেও ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের স্থান হৃদরোগের চিকিৎসার বিশ্বমানচিত্রে এক নম্বরে।
লেক ইরির তীরে এই ক্লিভল্যান্ড শহরের গোড়াপত্তন ১৭৯৬ সালে এক সময় উত্তর আমেরিকার লৌহ এবং ধাতু শিল্পের পীঠস্থান এবং শিল্প বিপ্লবের আঁতুরঘর। যদিও এই শহরে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা লোক অনেক তবুও এই শহর থেকেই সম্পদের আকাশ সোনা দিয়ে মোড়া শুরু হয়েছিল আমেরিকার অন্যতম সেরা শিল্পপতি রকফেলারের। সারা পৃথিবীব্যাপী তুমুল জনপ্রিয় কমিক চরিত্র সুপারম্যানের জন্ম হয়েছিলো এই শহরে, জেরি সেগাল আর জো সুস্টার নামের ক্লিভল্যান্ড এর দুই স্কুল ছাত্রের লেখা গল্প ও ছবি দিয়ে।
ক্লিভল্যান্ড থেকে মাত্র সাড়েতিন ঘন্টা ড্রাইভ করেই ঘুরে আসা যায় নায়েগ্রা জলপ্রপাত যার নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যের সাথে মিশে আছে এক প্রগাঢ় বিস্ময়। এই শহর কে ঘিরে আছে অনেক মনোরম গ্রাম যাকে বলা হয় কান্ট্রিসাইড। এইরকমই এক গ্রাম যার নাম ওমষ্টেড ফলস সেই গ্রামে কাটিয়েছিলাম বারোটি বছর। নিশুতি রাতের তারা ভরা আকাশ, দিগন্ত বিস্তৃত ভুট্টাক্ষেত আর বাড়ির ঠিক পেছনের দীঘিটি তে চোখ রেখে ডুবে যেতাম নিজের মনের গভীরে। এখানে বসেই খুঁজে পেয়েছিলাম আমার কবিতার বিমূর্ত মন্দাক্রান্তা কে। মধ্যরাতে বাড়ি ফেরার সময় এই শহরের ফুটপাথেই বলে ফেলতাম “দেয়ালে দেয়াল কার্নিশে কার্নিশ”।
গত পঁচিশ বছর ধরে এই শহর আমাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করেছে, পুড়িয়েছে, ডুবিয়েছে আবার মাথা উঁচু করে নিজের মতো করে বাঁচতেও শিখিয়েছে এই আমি কে। এই শহরেই আমি আজো কান পেতে রই পৃথিবীর কথা শুনিবার লাগি।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments