লকডাউনের দিনলিপি

লকডাউন মনকে বেঁধে দিতে পারেনি

অঙ্কন রায়


যেদিন আমার নতুন মোবাইল ফোন এল, পুরনো আধভাঙা ফোনটাকে বললাম, 'এবার তুমি বিশ্রাম নাও। অনেকদিন সয়েছো আমার অত্যাচার। এখন থাকো শুয়ে বসে।' 
সে কথা রেখেছিল। আমার বইয়ের তাকের এক কোণে অবহেলায় পড়েছিল। ধুলোর আস্তরণ ক্রমশ পুরু হচ্ছিল ওর খয়েরি চামড়ার পোশাকের গায়ে। যেন ঘুমোচ্ছিল। চলছিল এমন ভাবেই। হঠাৎ সব কিছু থমকে গেল! এবং লকডাউনের আগেই আমার নতুন ফোনটি আচমকা জবাব দিল!  
হয়তো সাময়িক ভাবেই, কিন্তু তাকে আর হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার উপায় রইল না। অতএব এই ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়িতে আমার পুরনো আর আমি একলাযাপন করছি। 
সারা বিশ্বের মানুষের উপর যে বিরল না দেখতে পাওয়া শত্রু তার মারণ থাবা বসিয়েছে, তার থেকে নিজেকে বাঁচাতে আর সমাজ সংসারকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার যে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিলেন, তাতে সামনের একুশ দিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল সমস্ত দেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সেই লকডাউনে এমারজেন্সি কাজকম্মো ছাড়া বাকি সবাই বসে আছি নিভৃতে, ঘরের কোণে। মুখে মাস্ক বেঁধে কোনওক্রমে দৈনন্দিন সব্জি বাজার বা ওষুধের দোকান, অতি দরকারে জ্বালানি ইত্যাদি সংগ্রহ করতে আপামর জনগণ দিনে বা দুদিনে একবার বেরোন বাড়ি থেকে। আবার চটজলদি ঢুকেও আসেন। কিছু নিরেট লোক দিনগুলোকে 'ছুটির দিন' ভেবে মৌজ করে আড্ডা দিতে বা রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে নেমে পুলিশের মার খান। 
আমার অবস্থা এই দু'য়ের কোনওটার মতোই নয়। কারণ আমি নিতান্ত 'অপ্রয়োজনীয়' একটি বিষয়ে চর্চা ও জীবিকা নির্বাহ করি। সেটা হল সঙ্গীত। গান শেখাতে বেরোই নানান স্কুলে, জমায়েতে। তা এই এমারজেন্সি পিরিয়ডে মানুষ বাঁচবে, খাবে নাকি গান শিখবে? সুতরাং আমি কাঠ বেকার এই মুহুর্তে। রোজগারও জিরো। সুবিধে একটাই, আমার ছোট্ট চারদেয়ালি ফ্ল্যাটের ভিতর আমি একা। টিকটিকি, পোকামাকড়দের কথা বলছি না। মানুষ হিসেবে একা। আমার রোজকার সব্জিবাজার, গ্যাসের দোকান, ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে দৌড়োনো ইত্যাদি করতে হচ্ছে না। 
ইতিমধ্যে আটদিন পেরিয়েছে। এখনও অনেকগুলো দিন। এবং সবচেয়ে বড় কথা একুশটা দিন গৃহবন্দি থাকার পরেও অনিশ্চিত ভবিষ্যত। এই লকডাউনের মেয়াদ বাড়তে পারে আরও। সবটাই ওই অদৃশ্য শত্রুটার আচরণের উপর নির্ভর করছে। আটদিন পেরিয়ে আজকের অনুভূতি লিপিবদ্ধ করছি। আজ মার্চের শেষ দিন। আজ একত্রিশ। লেখাটা শুরু করেছিলাম আমার মোবাইল ফোনের খবর দিয়ে। সেখানে ফিরে আসি। 
সেই যে নতুন ফোনটা আচমকা লক ডাউনের আগের রাতে জবাব দিল, আমায় ফিরে যেতে হল আমার পুরনো ঘুমিয়ে থাকা সেই অবহেলার সেলফোন-সইয়ের কাছে। বইয়ের তাকের ফাঁকে পুরু ধুলোয় ঢাকা তার জামা। লজ্জার মাথা খেয়ে ওকে বললাম, 'ফিরে আসবে বন্ধু? আমি নিরুপায়। চার দেয়ালে বন্দি। এখন কতদিন কোনও মানুষের মুখ সামনাসামনি দেখতে পাবো না— জানি না। সকলে কেমন একা— সবাই বুঝি পালালো। তুমি থাকবে তো বন্ধু?' 
মুখ ফিরিয়ে নেয়নি সেলফোন-সই!
আমায় শেখালো বন্ধুত্বের সংজ্ঞা। মুখে বলেনি। নীরবে শিখিয়ে দিল পুরনোকে অবহেলা করে সরিয়ে রাখতে নেই। দুর্দিনে সে দেখিয়ে দিতে পারে সেই প্রকৃত বন্ধু। প্রকৃত কাছের জন। পুরনো বন্ধুকে সচল করে তার মাধ্যমেই আবার আমার জগত উন্মুক্ত হল এই বন্দিদশায়। খুঁজে বের করতে লাগলাম বহু পুরনো বন্ধুদের, যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন নেই কোনও বার্তালাপ, নেই খোঁজ খবর নেওয়া বা যোগাযোগ রাখা। গান এল মনে— 'যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেমজালে... তবু মনে রেখো।' মনে রাখবো বন্ধু। সবাই একসঙ্গে থাকবো। 
শরীরে না থাকি। অবয়বে না থাকি। ভাবনায় থাকবো। আবার আকাশে বাতাসে থাকবো সবাই মিলেমিশে। লকডাউনের দুর্বিসহ দিন এই ভাবনাই আমায় ভাবিয়ে দিয়ে গেল। আরও মনে হল, সেই অদৃশ্য মরণডাককে বলি, তুমি চলে যাও। অনেক প্রাণ নিয়েছো। মানুষকে অসামাজিক হতে প্ররোচনা দিয়েছো। সেটা করতে পারোনি। আরও বেশি করে বন্ধনে জড়িয়েছি আমরা। দেখো, সকলে একা হয়েও আরও কাছাকাছি এখন। তুমি হেরে গেছো। তুমি চলে যাও। 
লকডাউন আমাদের ভালোবাসাকে আলাদা করতে পারেনি। আমাদের মনকে বেঁধে দিতে পারেনি।

ছবি : আবু

Post a Comment

0 Comments