আমেরিকা বাঁচাতে পারল কই?
অর্ণব ঘোষাল
প্রতি রাতেই বাড়ির প্রধান ফটকে তালা পড়ে। সেদিও পড়ল। তবে বেশ কিছুটা আগে, তাও ২১ দিনের জন্য!না, ২১ দিন ধরে তালা ঝুলবে না, সকাল হলেই খুলে যাবে। তবে মনে মনে ২১ দিনের জন্য এবাড়ির মানুষদের বাইরে যাওয়া পথ বন্ধ। আগে কি কখনো থেকেছি ২১ দিন ঘরের ভিতর ? হ্যাঁ থেকেছি তো!
তখন আমি বালক, একটা ঘরের ভিতরে মশারির মধ্যে টানা ২১ টা দিন কাটিয়েছিলাম। তখন আমায় বসন্ত রগে ধরেছিল। লোকজন দূর থেকে দেখা করত, কষ্ট হচ্ছে কিনা জানতে চাইত। শুধুমাত্র দিদা আমাকে খাবার দিয়ে যেতেন। আমি অতশত বুঝতাম না, ঠিক এখন যতটা শঙ্কিত হচ্ছি। ফটকে তালা পরার পরদিন থেকেই আমার চেনা বাড়িটাকে ছোট একটা জাহাজ বলে মেনে হতে লাগল। চেনা পাড়া হয়ে উঠল বন্দর। আশপাশের বাড়িগুলো ছোট বড় জাহাজ হয়ে উঠল। আমার বাড়ির সামনে পিছনের বাগান, খোলা তেতলার ছাদ জাহাজের ডেক হয়ে গেল। বাড়ির বাকি চার বাসিন্দাকে নিয়ে আমি হয়ে গেলাম জাহাজের কাপ্তান।
সবাই এক অজানা সমুদ্র যাত্রায় পাড়ি দিলাম। ২-৩ দিন ভেসে থাকার পর তটরেখা মিলিয়ে যায়, দিগন্ত রেখা আকাশে গিয়ে মেশে। পুব-পশ্চিম ঠাওর হয় না।
রোজই পড়ন্ত বিকেলে আদিকে নিয়ে ছাদে উঠে আসি। ঝকঝকে আকাশে প্রথম দিনে শুকতারা চেনাই। পরেরদিন কালপুরুষ... তারপর সপ্তর্ষি... ধ্রুবতারা। আকাশটা সেই ছেলেবেলার মতোই ঝকঝকে দেখায়। দাদু আমাকে এভাবেই আকাশ চেনাতেন। এখন আমি আর আমার ছেলে মিলে শুকতারা দেখে নিজেদের কাল্পনিক সমুদ্র যাত্রার দিক নির্ণয় করছি। কাল সকালে জাহাজ ভিড়বে কোনও এক অচেনা নাম না জানা বন্দরে। কেউ নামবে না, শুধু আমি যাবো ৫ দিনের সমুদ্র যাত্রা রসদ জোগাড় করতে। পাশাপাশি নৌকো চড়াও নিষেধ, শুধুই দূর থেকে কথা বলা যায়। রোজ বিকেলেই পড়শিরা যে যার জাহাজের ছাদে ওঠে। পায়চারি বা ব্যায়াম করে, চা খায়। ছাদ থেকে ছাদে কথা হয়। দূরের জাহাজের মানুষরা হাত নাড়ে। ঝুপ করে আঁধার নেমে এলে সবাই মিলিয়ে যায়। আমি একা ছাদে পায়চারি করি।
বেয়ার গিলের কাছে শেখা দুঃসময়ে কিভাবে নিজকে বাঁচাতে হয় মনে করার চেষ্টা করি। পরক্ষণেই ভাবি তাঁর দাওয়াই আমেরিকাবাসীকে বাঁচাতে পারল কই? রাস্তার হ্যালোজেন আলো জ্বলে ওঠে। আমার ছায়া পাশের বাড়ির চিলেকোঠার দেয়ালে আমার সঙ্গে পায়চারি করে। তাকে ফিরে আসতে বলি, বলি অন্য কারও বাড়িতে যাওয়া এখন বারণ। তবু সে কি কোথা শোনে। মন, সে তো আরও অবাধ্য। চলে যায় আরও সুদূরে। এক সময় ছোট ছোট ডিঙ্গি চড়ে যারা মাছ ধরতে গভীর সমুদ্রে গিয়েছিল, তাদের কাছে। হাতের মুঠো ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ খুলি। ওপ্রান্তে তখন সকাল, রাতজাগা শঙ্কিত মুখগুলো জানায় তারা ভালো নেই। অথচ তারা ভালো থাকবে বলেই তো একদিন সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিল। কিন্তু আজ, আমি আর আমার আশপাশের জাহাজগুলো কি বেশি নিরাপদে ভাসছি? ভয় হয়। ছেলেবেলার ভূত বা বাবাকে ভয়ের মতো একটা ভয়। হলিউডি সিনেমার মতো চাপা দম বন্ধ করা। এই ভয়টাই হয়তো আমাদের আগামী দিনে বাঁচিয়ে রাখবে। মনের কোণে একটা ইচ্ছেপুরান উঁকি মারে। কল্পনার সমুদ্রযাত্রাতে নিয়ে চলেছি মা-বাবা-ছেলে-বউকে আগলে। যেন রবিঠাকুরের বীরপুরুষ। না-না, আমি তো জাহাজের কাপ্তান। আমাকেই সবটা সামলাতে হবে। কাল জাহাজ নোঙ্গর করে যাব শ্যামবাটি বাজারে। একটা লাউ কিনব, আর কিনব কুঁচো চিংড়ি। নুন, তেল, আটা... আগামী ৭ দিনে যা যা লাগতে পারে সব। এক ফালি চাঁদ চলে আসে শুকতারা কাছে। উত্তরের আকাশে ধ্রুবতারা দেখা যায়। আরও একটা দিন পেরিয়ে যায়...!
13 Comments
চমৎকার
ReplyDeleteবেশ লাগল ভাবনাগুলো।
ReplyDeleteদারুণ!দক্ষ কাপ্তেনবাবু বেশ তরতর করেএগিয়ে গেলেন।
ReplyDeleteঅসাধারণ। যে টুকু বলবো কম মনে হবে। এখন মনে হচ্ছে ২১ দিন আমার কাছে সংখ্যা মাত্র। দারুন আপনি লিখতে থাকুন আমি পড়তে থাকবো।
ReplyDeleteWah...
ReplyDeleteআহা, অপূর্ব
ReplyDeleteউফফফ! অপূর্ব! এটা পরে ছোটদের পাঠ্যাংশ হওয়া উচিত।
ReplyDeleteকোয়ারেটাইন-এর প্রতিশব্দ যে জাহাজ হতেপারে তা কখনো ভাবিনি। দারুণ লাগলো। ১৪ দিন পর যদি জাহাজ নোঙর ফেলে তাহলে এসো একদিন চা খাওয়াবো।
ReplyDeleteতোমার জাহাজ যে বন্দরে এসে ভিড়েছে সেই বন্দরে আমার একটা ছোট্ট জাহাজ আছে। যাত্রী মাত্র তিনজন। সমুদ্র সৈকতে একদিন হাত নাড়া হয়েছিল বটে...... ক্যাপ্টেন তোমার যাত্রাপথ শুভ হোক। মাঝে মাঝে যেন সাড়া পাই।
ReplyDelete"ছাদ থেকে ছাদে কথা হয়। দূরের জাহাজের মানুষরা হাত নাড়ে। ঝুপ করে আঁধার নেমে এলে সবাই মিলিয়ে যায়। আমি একা ছাদে পায়চারি করি।" - আহা অর্ণবদা, দারুণ লিখেছেন। আমরা যে কতটা অসহায় প্রতি মুহূর্তে টের পাই।
ReplyDeleteOne beautiful and unique thing that I found in your writing is that you have not only made this lockdown a productive one for yourself but also for your family, and specially your son. Your are rightfully, the CAPTAIN.
ReplyDeletebesh bhalo likhechhen. pale hawa laga noukar moto tartar kare pade fellam. besh bhalo laglo.aro likhun.
ReplyDeleteOsadhon dada apnar dorshon amake mughdho kore
ReplyDelete