লকডাউনের দিনলিপি

গান শুনে কাজ করছি

অবন্তী চক্রবর্তী মুখোপাধ্যায় (ইংল্যান্ড থেকে)


প্রথম দিকে যখন বুঝতে পারলাম লকডাউন হতে  চলেছে, তখন মনে মনে বেশ অস্থির লাগছিল। কিন্তু একসপ্তাহ কেটে যাবার পর এখন এই ‘নিউ নরমাল’ এ আমরা বেশ ধাতস্থ। আমাদের বাড়ির চারজনেই একটু বেশিই নিয়ম মেনে চলতে পছন্দ করি। তাই আমরা প্রথমেই বানিয়ে ফেললাম একটা রুটিন। সোম থেকে শুক্র এক, আর শনি, রবি আলাদা।
তাহলে যদি সোম থেকে শুক্রের মধ্যে একটা দিনের দিনলিপি দেখি, সেটা আমাদের বাড়িতে কেমন? প্রথমত আমরা দুপুরে খুব কম খাই বলে রান্নার পাট নেই।  রান্না হবে বিকেল ছটার পর, তাও হাজার হাজার পদ নয়, সাধারণত দুটোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সকালে উঠেই প্রাতঃরাশ সেরেই যে যার ঘরে মেসিন খুলে কাজ আর কাজ, মাঝে মাঝে ব্রেক, তারমধ্যে যেমন চা বা কফি পড়ে তেমন বাগানে ছোট্ট করে এক পাক দৌড়ে আসাও পড়ে। বিকেল বেলা অনলাইন পিয়ানো, নাচের চর্চা। তারপর, চটজলদি রান্না করেই শুরু প্রগাঢ় শারীরিক অনুশীলন। হতে পারে জোরকদমে এক মাইল হেঁটে আসা, বা ক্রস ট্রেইনার।
এতো গেল ঘরের ভেতরকার কথা, এবার দেখি বাইরে কি চলছে। আমরা থাকি ইংল্যান্ডের উইনচেস্টারে, এখানে আমাদের গায়ের রঙের মানুষ একটু কম, অন্য শহরের তুলনায়। আর বাঙালি আছেন মাত্রই  তিন চারটি পরিবার, তাও বেশ ছড়িয়ে। আমরা মোটামুটি কিছু খাবার কিনে রেখেছি, কিন্তু দুধ, ফল, সবজি, একটু মাছ মাংস তো কিনতেই হচ্ছে, তাই আমরা চেষ্টা করছি সকাল বেলাতেই তাই সেরে ফেলতে। কারণ তখন পুরোমাত্রায় স্টক থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এখানে সরকার সকালের একঘন্টা বয়স্ক মানুষদের কেনাকাটার জন্য বেঁধে দিয়েছেন, তাই আমরা ঠিক সকাল ৮:৫০ বেরোচ্ছি, ৯ টার সময় যাতে দোকানে ঢুকতে পারি। আমি মাঝে মাঝে হাতে গ্লাভস পড়লেও, সেটার আসলে দরকার হচ্ছে না, কারণ সুপার মার্কেটের কর্মীরা ট্রলির হাতল ডিসিনফেকটান্ট দিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। মুখেও কেউ মাস্ক পরে নেই, কিন্তু দুটি মানুষের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব রাখা হচ্ছে। 
আমি সাধারণত Waitrose এ কেনাকাটা করি। সেখানে বাইরে এখন কিউ, ভেতরে গুনে গুনে লোক রাখা হচ্ছে, একজন বেরোলে আর একজন ঢুকতে পারছেন।  ঢোকার আগে আমার একটু টেনশন হয়, দরকারি সব পাবো তো? কিন্তু এখনো অবধি মোটামুটি সবই পেয়ে গেছি, যা যা কিনতে গেছিলাম। ফার্মেসি খোলা আছে, ওষুধেরও ঠিক মতো অনুপূরণ ঘটছে এসব নানা মেসেজে জানতে পারছি। লাইব্রেরি, কফিশপ, দোকান পত্রের ঝাঁপ বন্ধ। শুনলাম সাউথাম্পটনে (কাছের আর একটি শহর যেখানে অনেক ভারতীয় বাস করেন) ভেদিক টেম্পল এখন পরিষেবা বন্ধ রেখেছে। উইনচেস্টারে সবকটি চার্চের দরজা বন্ধ। সন্ধ্যেবেলাটা বেছে নিয়েছি হাঁটতে যাবার জন্য। রাস্তা প্রায় জনশূন্য, রেস্তোরাঁ, পাব বন্ধ, চেয়ার গুলো তুলে রাখা। কোনও কোনও টেক আওয়ায়ে খাবারের দোকান অবশ্য  খোলা।  কিন্তু, লোকে ঘরে বসেই অর্ডার দেবার কারণে দোকানের বাইরে কোনও লোক দাঁড়িয়ে নেই। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিসের দোকানগুলি খোলা শুধু, আর গাড়ির ফুয়েল। মাঝে মাঝে রাস্তায় আমাদের মতোই কয়েকজনকে শরীর রক্ষায় ট্র্যাকস্যুট আর ট্রেইনার পরে হনহন করে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে  কখনও  কখনও আপনার চোখে পড়তে পারে কোনও বাড়ির জানালার পাশেই রাখা টিভিতে প্রাইম মিনিস্টার-এর  ঘোষণা চলছে। এবার বাড়ি ফিরে দরজা খোলা এখন বেশ কৌশলে করতে হচ্ছে, হাতের বদলে কনুই ব্যবহার করে। তারপর হাত ঘষে ঘষে ধুয়ে, চাবি, মোবাইল স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করে, কোট ইত্যাদি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে একেবারে  শান্তি।
কিন্তু, রোজের রুটিন ব্যাপারটা এত সহজ ভাবে আসলে চলে না, হঠাৎ করে এমন কাজ এসে গেল যার জমা দেবার সময় ধার্য হয়েছে মাত্র ১০ দিনের মধ্যে। কারণ ওই কোম্পানিটি ধরেই নিয়েছে এখন যেহেতু বাড়িতে তাই সময় বেশি। এবার সপ্তাহান্তের কয়েকটা মিটিং সব ফেস টু  ফেস থেকে ভার্চুয়াল এ রূপান্তরিত হয়ে গেল, সেগুলোরও ঠিকঠাক প্রস্তুতি নিতে হবে। ম্যানেজার এর সঙ্গে খাটো গলায় কথা বলে যাচ্ছি, একের পর এক ইমেইল হজম করছি ।
তার ওপর জুটলো সোশ্যাল কানেকটিং এর জ্বালা। শুধু মোবাইল বা ল্যাপটপ এ কথা বলে, লিখেই শেষ নয়, একদম ভিডিও কমিউনিকেশন এপ্লিকেশন নিয়ে গল্প, গান এমনকি জুম্বাও চাই। মোবাইল হাতে নিলেই চারশো তার মতো মেসেজের সমাগম দেখছি। সেখানেও উপদেশ আর কৃত্য কর্মের ফর্দ। সেই ঠ্যালায় আবার  অংশগ্রহণ না করলে আমি আবার সামাজিক থাকবো না, তাই অগত্যা সেখানেও মাঝে মাঝে মুখ দেখতে হবে। অতএব, মনের মতো একটা গান শুনবো, একটা কবিতা পরবো, কিছু লিখবো বা খানিকক্ষণ  চুপটি করে আমার প্রিয় নিরিবিলি বুদ্ধা কর্নারটির দিকে তাকিয়ে বসে থাকবো, সে সুযোগ ও  ঘটছে না।
অতএব, এখন হাতে আমাদের অতিরিক্ত সময় তো নেই, বরং একটু কাড়াকাড়ি। আর সত্যি কথা বলতে কি, মনের মধ্যে একটা চাপা ভয়, চিন্তা সবসময় মনটাকে যে ভাবে আছন্ন করে রেখেছে যে এখন মেজাজ ও নেই যে  আনন্দ করে কিছু করবো, যেটুকু করছি চাপে পড়ে করতে হচ্ছে, মনটাকে বিমুখ করার জন্য। সে কারণেই অন্য সময় বাড়ি থেকে কাজ করার সময় অনেকগুলো উইন্ডো খুলে গান শুনতে শুনতে কাজ করি, আজ সেখানে চারজনে যে যার ঘরে চুপচাপ বসে মন দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। 

Post a Comment

1 Comments