লকডাউনের দিনলিপি

গৃহ যুগ 

মৌমন মিত্র (নিউ জার্সি থেকে)


ব্যাক ইয়ার্ড জুড়ে এক ঝলক হাওয়া। আজ নিয়ে এক ফোরটনাইট হল জীবনের এইটুকু ছুঁয়ে দেখিনি। আমি কেন! আমার মতো সারা শহর! নিউ জার্সি। আমার পাশের শহর নিউইয়র্ক। এই দেশের পথঘাট, এমন ব্যাস্ত-বিহীন, আমার এত বছরের মার্কিন অভিজ্ঞতায় চোখে পড়েনি। কামিউনিটির সব ক’টা গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে। যেন জীবনের কোনই হেলদোল নেই। অথচ এইভাবেই বোধহয় জীবন বাঁচবে। এক এক করে। যখন লিখছি, নিউইয়র্ক স্টেটে এক রাতের ব্যাবধানে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬৭,৩৮৪ গোটা আমেরিকায় এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাস কেস ১৬৩,৮০৭ মৃতের সংখ্যা ৩০০৮।
জীবনের এই ফেজে এসে, অন্দরমহল, অনির্দিষ্টকালের জন্যে আমাদের কাছে এক যুগের মতো মনে হয়।
আমি এই দেশে আসার পর, প্রথম শিখেছিলাম, যে জীবন অপশানলেস হয়েও বাঁচা যায়। অন্তত ভারতীয় পরিধির ক্ষেত্রে। আসলে সেই আমলে, ভারতীয়দের আমেরিকা ব্যাপি এত বাড়বাড়ন্ত ছিল না। তখন শ্যাড-কে ইলিশ, ক্যাট ফিশ- কে মাগুর আর স্যালমন-কে আড় মাছ ভেবেই গিলতে হত। কলিং-কার্ড কিনে পরিবারের সঙ্গে বাঁধা সময় মেপে কথা বলতে হত। স্বামী শিখিয়েছিল, এত দূরে রয়েছি, সকলকে ভাল আছি বলবে। একটা ছোট্ট টিভি পর্দায় সারাদিন আমেরিকান অ্যাকসেন্ট চলছে, যার অর্ধেক প্রায় হিব্রুর মতো শোনাতো। হাতে গোনা ভারতীয় বন্ধু, বাঙালি এক বা দুজন। কিন্তু, তারাই সেরা কানসাশান! আজও! সেই সব শহর আজ কত অচেনা। বাতাসে বসন্ত কেমন থমকে রয়েছে। পাখির কূজন, আমার ঘরের জানলার কাঁচের এই পারে দাঁড়িয়ে কিছুই কানে আসে না। এর ফাঁকে টুপটাপ বৃষ্টি। কখনও হালকা যা মন বয়ে নেয়, কখনো ঝাপটায় চোখের পাতায়। কলকাতা, তোমায় দারুণ মনে পড়ছে।
আমার কয়েক দরজা পর এলেনার বাড়ি। এলেনা আর ওর স্বামীর দু-বছর ব্যাপি ইনফারটিলিটি ট্রিটমেন্ট আপাতত স্থগিত। অনির্দিষ্ট কালের জন্য। ওরা ট্রিটমেন্টের প্রায় শেষ পর্যায় দাঁড়িয়ে ছিল। এখন, ওরা প্রকৃতির প্রকৃত নিয়মে, যদি কোনও এক করোনা-মুক্ত ভোরে প্রেগনেন্সি টেস্টে পজিটিভ কিছু পায়। করোনায় আক্রান্ত না হয়েও পথ হারিয়েছে এই দেশের তিন লক্ষ্য মানুষ। জবলেস এই মানুষেরা আজ দিশাহীন। আজ জোসেফ পাল্মা, বেয়ারলি, নিজের জীবন চিনতে পারে।
মঙ্গলবার মাইয়ামি বিমানবন্দরে কাজে যাচ্ছিলেন জোসেফ। পরের দিন তাঁকে বিনা বেনিফিট কাজ থেকে লে-অফ করা হয়। ফেডারেসাশান জানাচ্ছে করোনা ভাইরাসে যবলেস হতে পারে ৪৭ মিলিয়ন মানুষ। আনএমপ্লয়মেটের রেট ৩২% পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। ভেনটিলেটর, মেডিকাল ইকুইপমেন্টের অভাবে নিউ ইয়র্কশহরে, রাতের পর রাত বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। হসপিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রেফ্রিজারেটেড লোডেড ট্র্যাক। থরে থরে জমছে মৃতে দেহ। প্রত্যেক ৬ মিনিটে নিউইয়র্কে একটা করে মৃত্যু ঘটছে!
এরই ফাঁকে বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়েছে হোমস্কুলিং। বিভিন্ন প্ল্যানিং ও তৎপরতায় প্রত্যেক দিন শিক্ষকরা টাস্ক পাঠিয়ে দিচ্ছেন অনলাইন। সময়সীমার মধ্যে তা জমা দিতে হচ্ছে পড়ুয়াদের।
কিন্তু কলেজ সিনিওররা এখন থেকেই আতঙ্কিত। এই আসন্ন রিসেস পিরিয়ডে তারা কোথাও ইন্টার্নশিপ পাবে না। ২০২০ এবং ২০২১ এ যারা কলেজ গ্র্যাজুয়েট হবে, তাদের জীবনের ক্যারিয়ার প্রসপেক্ট এখন থেকে চূড়ান্ত বিপদগ্রস্ত।
বাড়ির ভিতর গৃহযুদ্ধ চলছে ঘরে ঘরে। কেবিন ফিভির। মানুষ আতঙ্কিত। প্রতিফলন পড়েছে সম্পর্কে। যাদের চাকরি নেই, তারা রিডিউসড ফান্ড নিয়ে আশঙ্কায়। যারা হোম-অফিস করছেন, তাদের মাত্রারিক্ত, একে অপরকে রোজ এত সময় ধরে দেখে ক্লান্ত।
কিছুদিনের মধ্যে এখানে বসন্ত-বৃষ্টির সঙ্গে নেমে আসবে ফুলের বাহার। চেরি-ব্লসাম তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রতি বছর এই চেরি-ব্লসাম দেখতে মানুষের ঢল নামে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অবশ্য তাঁর সঙ্গেই বহু মানুষ সিজানল--অ্যালাৰ্জিতেও ভোগেন। কিছুদিন বাদে সেই উপসর্গও এক আতঙ্কে দাঁড়াবে মানুষের কাছে।
জীবন কবে স্বাভাবিক গতিতে ফিরবে কেউ এখানে জানে না। দৈনন্দিন হাইওয়ের ওপর দিয়ে যাওয়া গাড়িরা স্থির হয়ে যেন আকাশের মন গুনছে। যত দূর চোখ যায় কেউ কোত্থাও নেই। প্রত্যেক সকালে উঠে নিউজপেপারে আগে খোঁজনি সবাই ভালো তো? সর্বোপরি, সবাই বেঁচে তো?
জীবনের এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণ। নিজের মা-কে, মাদার—নেচারকে আমরা সর্বগ্রাসী হয়ে অবিন্যস্ত করেছি। ‘হে নব সভ্যতা’, আজ জাতি ভুলে, রাজনীতি ভুলে, হানাহানি ভুলে, নিজেকে ভুলে, সেই অরণ্যে ফেরার এই স্বর্ণ সুযোগ! করোনার গৃহ যুগে বসে মনে হয়, এ লড়াই শেষ হোক। আমাদের ‘পাষাণপিঞ্জরে’ জেগে উঠুক শুভ নিঃশ্বাসের আলো।

Post a Comment

2 Comments

  1. লেখাটার পড়তে পড়তে দমবন্ধ লাগছে! অদ্ভুত আতঙ্ক!

    ReplyDelete
  2. Abhigyota ta onek ke onek kichu sekhabe jodio chorom dhakka diye

    ReplyDelete