কী আছে– মানুষ না মৃতদেহ?
সৌরভ নীল
নির্জনতা এত ভয়ঙ্করও হয়ে উঠতে পারে! ঘরবন্দীর আজ কুড়িদিন। অথচ কতদিন এই ঘরবন্দীর স্বপ্ন দেখতাম! নির্জনতার স্বপ্ন দেখতাম! ভাবতাম কাজকর্ম থেকে বেশ কিছুদিন টানা ছুটি নিয়ে ঘরেই থাকব। বেরোব না কোত্থাও। যে বইগুলো পড়ে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠেনি সেগুলো শেষ করব। যে চিন্তাগুলো মাথাতেই নড়ে বেরাচ্ছে বহুদিন আর থেকে থেকে এক দীর্ঘশ্বাস দিয়ে জানান দেয়— লিখে শেষ করব।
অথচ কিছুই হচ্ছে না এখন। বাইরের পরিবেশের সঙ্গে ভিতরটাও কোথাও যেন থমকে গেছে— যেভাবে থমকে গেছে আকাশ আর বাড়ির সামনের শুনশান বাইপাস। কেন? তারও যে উত্তর পাই না ভাবতে বসলে। কতকাল ভেবেছি ছুটি পেলেই চলে যাব দূর কোনও পাহাড়ে বা শুনশান সমুদ্রতটে। বন্ধের দিনে ফাঁকা রাস্তা দেখে বেরিয়ে পড়তাম গাড়ি নিয়ে— সোনাঝুরি যেতাম— যেতাম বল্লভপুর জঙ্গল— শুধু ফুসফুস ভরে অক্সিজেন নেবো বলে— অনেকটা দূর অব্দি আকাশ দেখব বলে।
ধর্মতলার বিশাল চৌমাথায় দাঁড়িয়ে কতবার মনে হয়েছে একদিন যদি সমস্ত ব্যস্ততা থামিয়ে এখানে ফুটবল খেলা হয়! কখনও বা মনে হয়েছে, ডানকুনি-পালসিটের টোলট্যাক্স বন্ধ করে সামনে যদি ক্রিকেট খেলা হয়! হাইওয়ে ধরে দূর্গাপুর যেতে যেতে দুদিকের সমুদ্র-বিস্তৃত ধু-ধু-খাঁখাঁ ওয়েস্টল্যান্ড জুড়ে, কতকাল মনে হয়েছে, এই হয়তো অটবটস আর ডিসেপ্টিকন্সের লড়াই হবে আর আগুনের ফুলকি ঝরে পড়বে চারিপাশে! দূরের ওই কারখানা যেন রুশদির উপন্যাসের আলিফবে’র সেই শহর যে নিজের নাম ভুলে গেছে নিদারুণ এক শোকে— যে কারখানাগুলো শুধুই দুঃখ উৎপাদন করে!
ছোটবেলায় গ্রীষ্মের খাঁ-খাঁ শূণ্য দুপুরগুলো কাটত পাড়ার এক ভাঙ্গা-পোড়ো ধান মিলে। নির্জনতার প্রতি ভালবাসা বোধহয় সেখান থেকেই সৃষ্টি। কত কত রাত— পূর্ণিমা— অমাবস্যায়— সাইকেল নিয়ে ছুটে গিয়েছি সোনাঝুরির রাস্তায়— খোয়ায়ের ধারে। তখন বন ছিল, এখন হাট ছাড়া কিছু নেই। অন্ধকার সেই নিঝুম নিশ্চুপ মোড়াম রাস্তা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় বা অমাবস্যার অন্ধকারে তখন যতটাই এক নৈস্বর্গিক অনুভূতি দিয়েছিল— আনন্দ দিয়েছিল — আজ শহরের ঝাঁ চকচকে আলকিত থমথমে রাস্তা ততটাই বিষণ্ণ করে তুলছে। অথচ কতকাল ধরে খুঁজে বেরিয়েছি সেই নির্জনতা–শূণ্যতা– ছুটে বেরিয়েছি পাহাড়ে, জঙ্গলে, সমুদ্রে।
অথচ এখন প্রতিরাতেই ছাদে উঠলে মনে হয় ঘুমিয়ে আছে পাড়া, যেভাবে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ে মায়েদের ‘ছেলে ঘুমাল, পাড়া জুড়ালো’ গানে – বর্গীর ভয়ে অথবা দস্যূর ভয়ে। নিচের ঘর থেকে খবরের শব্দ বয়ে নিয়ে আসে বিশ্বজুড়ে ষাট হাজার মৃত্যুর বার্তা। ভাবি, বাড়ির সামনে মাঠে অন্ধকারে সাদা কাপড়ে মোড়া ষাট হাজার মৃতদেহ শুইয়ে রাখলে কি মনে হবে সাদা কোনও ফুল ফুটেছে অথবা আকাশ ভেঙে পড়েছে শূণ্যে, বুক ভরা তারা নিয়ে? ভাবতে থাকি। ভয় হয়। নির্জনতা, শূন্যতার কথা ভাবলেই মৃত্যুর কথা মনে পড়ে।
মৃত্যুও বোধহয় এটাই শূণ্য, নিঃসঙ্গ, নির্জন। দূরে ওই বাইপাশে বহুক্ষণ বাদে পেরিয়ে যাচ্ছে একটা দুটো গাড়ি – কখনো ছোট ট্রাক, কখনো বা এ্যাম্বুলেন্স – হু হু করে ছুটে যাচ্ছে শূণ্যতার বুক বাজিয়ে। আমি চেয়ে থাকি যতক্ষণ না হারিয়ে যাচ্ছে চোখের কিনারে– দেখার চেষ্টা করি– কী আছে– মানুষ না মৃতদেহ?
2 Comments
Oshadharon
ReplyDeleteFelt it❤
ReplyDelete