লকডাউনের দিনলিপি

নতুন করে বাঁচতে শিখলাম

সারদা বসু মুখোপাধ্যায়


এখন বরিষণ মাত্র পাঁচ, গৃহ্বন্দি সেও। করোনা নামক এক রাক্ষস আকাশ জুড়ে রয়েছে। একদিন বড় হয়ে ইতিহাসের পাতায় পড়বে এই মারণ রোগের সঙ্গে মানুষের অক্লান্ত হার-জিতের খেলার গল্প। মনে পড়ে যাবে হয়তো তখন মায়ের সঙ্গে কাটানো গৃহবন্দি দশা দিনগুলির কথা।
প্রথম দফা লকডাউন, দ্বিতীয় দফা লকডাউন, তৃতীয় দফা লকডাউনে দীর্ঘ হচ্ছে বন্দিদশা। এই কঠোর নিয়ম যতই কঠোর হোক না কেন বেঁচে থাকার একমাত্র পথ, প্রশাসন তৎপর এই মূলমন্ত্র বোঝানোর, উদ্দেশ্য একটাই, বাঁচতে হবে। আমাদের বাড়িটা ঘিরে রয়েছে বড় বড় খেলার মাঠ। বন্দি হওয়ার আগেও ওর লাল সাইকেলটা নিয়ে এই মাঠে কেটে যেত সারা বিকেল। এখন প্রায় এক মাস হতে চলল, যাওয়া হয় না আমাদের। ওকে বলেছি, মাঠ ভর্তি লাল পিঁপড়ে হয়েছে, গেলেই কামড়াবে। বাড়ির বাগানে এখন কটা প্রজাপতি এসে বসছে, সেই নিয়ে রোজ অনেকটা বিকেল কেটে যায়।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঘাসের ডগায় দোল খাওয়া সাদা, বাসন্তী, নীল, রঙ-বেরঙের প্রজাপতি গুলির খবর তো বহুদিন নেওয়া হয় না। সারা বিকেল ওর সঙ্গে খেলতে গিয়ে আমিও এই কদিনে আমার মুঠোফোনে বেশ কয়েকটি প্রজাতির প্রজাপতিদের বন্দি করেছি। বাগানে, আমার ঠাম্মার লাগানো কিছু স্টার লিলি আছে, যা কিনা শুধু ইস্টারের সময় অর্থাৎ এই সময়টা ফোটে। হালকা গোলাপি রঙের এই ফুলে প্রজাপতিদের আড্ডা। রোদের দাপট বাড়ার আগে অবধি বারান্দায় বসে বেশ লাগে দেখতে ছোট্ট একটি শিশুর অদম্য দুষ্টুমিতে তাদের আড্ডা ভঙ্গ হচ্ছে বার বার।
সকালবেলা দরজা খুললেই বারান্দা ভর্তি পাতা বাদামে পা পড়ে। এমন শব্দ হয়ে ওঠে যেন মনে হয় সবাই একসঙ্গে কথা বলে উঠলো। চারিদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে পাখিদের কলকাকলির সঙ্গে পাতার  শব্দ মন খারাপের রাত ভুলিয়ে দেয়। পাতা বাদাম গাছটায় প্রায়ই সপরিবারে হনুমানের দল আসে, এ ক’দিনে বরিষনের চেনা হয়ে গেছে ওদের মা-বাবা, ছানাপোনা, আত্মীয়-পরিজন সকলের সঙ্গে। নিজেও দিব্যি শিখেছে পাতা বাদাম খেতে।
সামনে রাস্তা দিয়ে এখন কোনও গাড়ি যায় না। মোবিল পোড়া গন্ধ বহুদিন পায়নি। শীতের সময় লাগানো পিটুনিয়ার গন্ধ ছাপিয়ে যায় বেলীফুল গুলিকে। দু’দিন ধরে কালো হয়ে আসছে বিকেলের আকাশ। দু ফোঁটা বৃষ্টিও হল, এবছরের প্রথম সোঁদা মাটির গন্ধ পেলাম। বারান্দায় বসে আমরা দু’জনে মিলে টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়ার ফাঁকে ফাঁকে কালো মেঘ দেখছিলাম। ভোরের আকাশ থেকে সন্ধ্যার আকাশ অবধি যে কটি রঙ আকাশ মাখে তা বরং আকাশই চিনিয়ে দিক ওকে। ছোট মানুষ, তার ছোট্ট ছোট্ট অজস্র প্রশ্ন। আমি আর কতটুকুই বা জানি কিই বা শেখাতে পারব, উত্তর দিতে দিতে ভাবছিলাম এই রং আর রংমিলান্তি খেলা শিখুক ও প্রকৃতির কাছে। ফুল চিনুক ও ফুলের কাছে, ফুলের সৌরভে, সৌন্দর্য্যে।
বাড়ির সামনে শিমুল গাছটা যখন লাল হয়ে ছিল ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম শিমুল ফুল কোড়াতে। মাঝে শুধুই মরা গাছের মতো শুকনো ডাল মেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি তাকে। বেশ কদিন হলো কচি পাতায় ভরে গেছে। আজ সকালে বসে যখন বারান্দায় ভূতের রাজার তিন বরের গল্প বলছিলাম, ঠিক চোখে পড়ে পড়েছে ওর, বলে উঠলো— ‘‘মা দেখো লাল গাছটা সবুজ হয়ে গেছে।’’ অগত্যা ভূতের রাজাকে সরিয়ে গাছের রং বদলানোর গল্প করতে হল।
বাগানওয়ালা বাড়ির একটা মজা আছে। ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে না এখানে। পাখির দল বাড়ি ফেরে, তারপর আস্তে আস্তে আকাশে শেষ রক্তিম আভা মেলায়, এক দুটো তারা ফোটে। ফলে সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি আকাশ, পাখি ফুল, প্রজাপতি সব নিয়েই একটা ভরা সংসার।
কে বলেছে বন্দিদশা খারাপ, কষ্টকর বা অসহ্য?
নিয়মে বাধা জীবন থেকে দূরে, প্রকৃতির কোলে ছোট্ট প্রাণের বিকাশ, এও তো শিক্ষা।
আমি আর বরিষন মিলে আমার জানলার গায়ে গায়ে একটা ভার্টিক্যাল গার্ডেন করেছি কদিন হল। খুঁজে খুঁজে বাগান থেকে কিছু দীর্ঘস্থায়ী পাতাবাহার এনে ছোট ছোট প্লাস্টিকের বোতলের সাহায্যে সাজিয়েছি দু’জনে মিলে এই বাগান। বরিষণ শিখেছে কিছুই ফেলার নয় সব কিছুই জীবনে কোনও না কোনও কাজে লাগে। বন্দিদশা কঠোর হলেও শেখালো আমাদের নতুন করে বাঁচার। আত্ম চিন্তন, আত্ম বিশ্লেষণকে একটু সময় দেওয়ার, সময় পাওয়া গেছে। প্রাণের ভয় শিখিয়েছে প্রাণের যত্ন নিতে। বিশ্বপ্রকৃতির হাত ধরে ছোট ছোট বরিষণরা সাজিয়ে নিক আবার নতুন এক পৃথিবী, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিক সেই পৃথিবীতে।

Post a Comment

3 Comments

  1. কি অপূর্ব লেখনী ... চোখের সামনে সবটা ছবি হয়ে ফুটে উঠল....অনেক ভালবাসা দিলাম আমাদের ছোট্ট বরিষণ কে যে আগামীর পৃথিবীটা আবার সুন্দর করে তুলবে

    ReplyDelete
  2. কি অপূর্ব লেখনী ... চোখের সামনে সবটা ছবি হয়ে ফুটে উঠল....অনেক ভালবাসা দিলাম আমাদের ছোট্ট বরিষণ কে যে আগামীর পৃথিবীটা আবার সুন্দর করে তুলবে
    -অনুশ্রুতি
    Reply

    ReplyDelete