আনন্দপাঠশালা

স্মৃতির জলে স্নান

রিম্পি


পাঠভবন ছেড়ে এসেছি বহুকাল, তবু এখনও শুকনো পাতাবাদামের মতো উড়ে আসে দু চারটে স্মৃতি! হাতের মুঠোয় লেগে থাকে তার ধুলো ধুলো গন্ধ। আসনের সুতোয় ভাঙা পাতাবাদাম আটকে যাওয়ার মতো এ সুখস্মৃতি আটকে রাখি মনে। তবু মেনে নিতে হয়, তাড়াহুড়োয় কাঠবিড়ালির এগাছ থেকে ওগাছ ছুটে যাওয়ার মুহূর্তগুলো আজ অতীত। জানতে ইচ্ছে হয়, গাছপালাগুলো ভাল আছে তো?
সন্তোষালয়ের পিছনের নাগকেশর, ঘন্টাতলার বট, লাইব্রেরীর পিছনের অশোকগাছ, কতটা বয়স হল ওদের! মনে মনে কেউ উত্তর দেয়, একচুলও বাড়েনি ওরা। যাদের ছায়ায় আমরা বকুল বীজের বাঁশি বাজিয়েছি, যার নিচে আমরা এঁকেছি কিতকিতের ছ’টা ঘর, তারা স্মৃতি বুকে নিয়ে এখনও নাকি একই রকম থেকে গেছে। আসলে এরকম ভেবে নিতে ভাল লাগে। তবু জানি, বাস্তবে হারিয়ে গেছে আমাদের দিনগুলো। যে দিন এসেছে সে অন্যদের, নতুনদের। আমরা হাওয়ায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছি কোথাও।
মনে পড়ে তখন আমরা আনন্দ পাঠশালা ছেড়ে পাঠভবনে এসেছি। একদিন উত্তরায়ণে নিয়ে যাওয়া হল আমাদের। সম্ভবত সেটা আমাদের অর্থাৎ, ছোটদের আউটিংয়ের দিন ছিল, অথবা প্রকৃতিপাঠের ক্লাস, ঠিক মনে নেই। তো ওখানে গিয়ে বিরাট সাদা সারস পাখিটা দেখে কী যে রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি হল সেদিন, সে বলে বোঝানোর নয়। একপাশে একঝাঁক খরগোশও খেলা করছিল। গাছে গাছে ডাকছিল পাখি। কেউ একটা বলেছিল, ওই সারসটার বয়স নাকি অনেক! ওকে দেখার জন্যই পরপর বেশ ক’বার গিয়েছিলাম বন্ধুরা। কিন্তু একদিন আর দেখতে পেলাম না। হঠাৎ না বলেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল পাখিটা! সেদিন বুঝেছিলাম, হারিয়ে যাওয়া এরকমই হয়।
ছোটবেলায় প্রকৃতিপাঠের ক্লাস করতে আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগত। অজানা গাছেদের সঙ্গে আলাপ তো সেই ক্লাসেই। একদিন ক্লাস থেকেই গাছ চেনাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমাদের। গাছ চিনে ফিরে আসার আগে, সবাই মিলে তিনপাহাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বটগাছের সঙ্গে সেই প্রথম বন্ধুতা। বটের ঝুড়িতে দুলতে দুলতে শেষমেশ ঘন্টা পড়ে গেল। ফেরার পথে বাঁ পাশে আনন্দ পাঠশালার বেড়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরছিলাম। নাম ধরে ডাক দিচ্ছিলাম মৌসুমি মাসি, শ্রীলেখা মাসি, জয়শ্রী মাসিদের। তবে সাড়া দেয়নি কেউ। বুঝেছিলাম, ক্লাস চলছে ওঁদের। তাই ফিরে আসতে হল। আসলে ফিরে আসতেই হয়। এই তো কদিন আগেই শুনলাম মৌসুমি মাসিও চিরকালের মতো ফিরে গেছে অন্য এক দেশে। হারিয়ে গেছে তারার রাজ্যে!
মনে পড়ে, একসময় প্রকৃতিপাঠের ক্লাস নিতেন খোকাদা। চা চক্রের কাছে, সেই বেদি আজও খোকাদার বেদি নামেই পরিচিত। বেদির সামনে চন্দন গাছ থেকে লাল লাল বীজ পড়ে থাকত। আমরা কুড়োতাম। কখনও সেই বীজ, ধুলোয় ঢাকা পড়ে যেত। আসন বিছাতাম সেই ধুলোর উপর। খোকাদা এসেই প্রশ্ন লিখতে দিতেন। তাঁর সব প্রশ্নেরই প্রথম শব্দ ছিল ‘একটি’। মানে, “একটি পাখির নাম লেখ যে....” অথবা “একটি গাছের নাম লেখ যে....” এই ধরনের। আমরা প্রশ্নের উত্তর লিখতাম। উত্তর দেখাতে গিয়ে বানান ভুলে কী যে বকা খেতাম! ভয়ও পেতাম ভীষণ। একবার তো, কী যেন একটা প্রশ্ন দিয়েছিলেন, যার উত্তর হত হাতি। আমাদেরই এক বন্ধু হাতিকে লিখেছিল ‘হাঁতি’। সে দেখে খোকাদা বকবেন কী! বকা ভুলে হাসতে লাগলেন। ঠাট্টা করে ওকে বললেন, ‘তুই একটা আস্ত হাতি। ‘বলেই আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘তোরা সবাই একে এবার থেকে হাতি বলে ডাকবি’। কিন্তু একদিন সে ক্লাস থেকেও আমাদের চলে যেতে হল। রুটিনে তখন ‘প্রকৃতিপাঠ’ ক্লাসের বদলে জায়গা করল ‘জীবনবিজ্ঞান’। কেমন হুট করেই বড় হয়ে গেলাম আমরা। কত গাছ যে অচেনা থেকে গেল! কত বানান ভুল করা বাকি থেকে গেল আমাদের!
 ভরা গ্রীষ্মে মাথার ওপর পাখা পাইনি আমরা, বর্ষায় পাইনি ঘর। কিন্তু আমরা এ সময় অশোক গাছটাকে খুব কাছ থেকে কমলা দেখতে পেতাম, নাগকেশরকে ফুলে ফুলে সাদা। গরমের মধ্যেই যে বাতাস বইত সে বাতাস নিয়ে আসত আমের মুকুলের গন্ধ। দেওয়াল টপকে সচরাচর যে গন্ধ ঘর অবধি পৌঁছোয় না, সে গন্ধের মধ্যে খোলা আকাশে আমাদের নিত্য আনাগোনা ছিল। তাই হয়তো পাখার বাতাস না পাওয়ার অভাব বোধ হয়নি কোনওদিন। ভাগ্যিস! প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মতো বিরাট শিক্ষা আমাদের পাঠভবন দিয়েছিল। তাই বোধহয়, মাটিতে বসলে আজও আমাদের পোশাক ধুলোয় নষ্ট হয় না। তাই বোধহয় পাখা ছাড়াও দিব্যি থেকে যেতে পারি। তাই তো ঘরের মধ্যে ক্লাস করতে করতে মন হাঁসফাঁস করে ওঠে, চোখ যায় জানলায়... চোখ যায় দরজার দিকে...।
আসলে বাস্তবে সেইসব দিন হারিয়ে ফেললেও, কোথাও যেন কিচ্ছু হারাইনি, এমনটা ভাবি বারবার। ভাবনার মধ্যে কিছু হারাইনি বলেই বোধহয় বসন্ত শেষে পাতাবাদাম উড়ে এসে স্পর্শ করে মন। ধুলো ধুলো গন্ধে এ যেন এক স্মৃতির জলে স্নান। যার রেশ থেকে যায় বসন্তের পর বসন্ত। এই পাঠভবনের স্মৃতিই তো একমাত্র জায়গা, যেখান থেকে আমরা আজও ছিটকে যেতে পারিনি কেউ কোত্থাও...!


শিল্প : লেখক


Post a Comment

2 Comments