লকডাউনের দিনলিপি

খুলে যাচ্ছে হাজার দরজা

নীপবীথি ভৌমিক


লকডাউনের দ্বিতীয় পর্বও প্রায় শেষের মুখে। গৃহবন্দি জীবন আমাদের এখন। কিন্তু লকডাউন, অর্থাৎ তালাবদ্ধ। কিন্তু কোথায়? কিসের? কিভাবে? এই প্রশ্নগুলো দেখে নিশ্চয়ই সবার মনে হতে পারে, কি অদ্ভুত সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে বসেছে এমন একটা প্লাটফর্মে এসে। এতগুলো দিন হয়ে গেল আমাদের তালা চাবি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া জীবনের, অথচ কি অবান্তর কথাবার্তা এসব? আসলে, কি জানেন তো, তালায় চাবি লাগিয়ে দিয়ে সরকার যতই আমাদের ঘরে বন্দি করে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, চাবিটা বোধহয় আমাদের হাতেই রয়ে গিয়েছে কোনও না কোনও ভাবে। রয়ে গিয়েছে আসলে, সে চাবি নিয়ে চলে যাওয়ার সাধ্য যে সরকার বা রাষ্ট্রের কখনই নেই। সেটা আসলে আমাদের মনের চাবি। শরীরটা রেখেছি ঘরে আমাদের। মনটাও হয়তো রাখতে চেয়েছি সেভাবেই। কিন্তু, শরীর আর মন, দুটো স্বত্ত্বার সংজ্ঞাই যে সাংঘাতিক ভাবে বিপরীতমুখী। এতো আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারি না। এই যেমন দুম করে হঠাৎই কন্যার এগারো ক্লাসের পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেল। যত ভাবছি, যা হয়েছে তা হয়েছে, কিংবা না হলেও কি, আগে তো মানুষের জীবন, তবুও যেন মন যে সেই কেন কেন করে উঠে  বুঝতেই পারি না। এমন নানা সমস্যা ঘিরে রয়েছে যেন গৃহের চারিদিকে। হয়তো এ সমস্যা শুধুমাত্র আমার, আপনার নয়। এ আমাদের আমজনতার সমস্যা। কর্তার স্কুলের সমস্যা। অনলাইন ক্লাস। কন্যারও সেই এক অবস্থা। সারা দিন ফোন, ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখের ব্যাথা। অথচ এই করোনা কালে কোথায় তো আর এইসব তুচ্ছ রোগের চিকিৎসাও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। সত্যি মনকে আর রাখা যাচ্ছে না গৃহবন্দি করে। ওই যে চাবিটা সরকার বা রাষ্ট্র নিতে ভুলে গিয়েছিল, সেই চাবিটা দিয়েই এক একটা করে খুলে যাচ্ছে মনের হাজার দরজা, লাখো জানলা। ছুটে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি, ভাবছি একটু আলো পাব, একটু বাতাস আসবে এই বদ্ধ মনের ভ্যাপসা ঘরে। কিন্তু কোথায়? বরং আরও আরও সমস্যা এসে যাচ্ছে চোখের সামনে। ভিড় করে আসছে মাথার ভিতর।
বিবাহসূত্রে শান্তিনিকেতনে। বাবা মা থাকেন অনেক দূরে। উত্তর চব্বিশ পরগনায়। শুনছি উত্তর চব্বিশ পরগনার কিছু অংশে রেড জোনে রাখা হয়েছে। যদিও আমাদের বাড়ি যেখানে সেখানে এখনও পর্যন্ত অবস্থা ভাল। তবুও সেই যদি যদি প্রশ্নরা বারবার একা পেলে আমাকে ভীষণ ভাবে ভাবিয়ে তুলতে চাইছে। অথচ ভাগ্যের কী পরিহাস, ফোন করতে গেলেই আগেই ভেসে আসছে ও প্রান্ত থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে। সরকার থেকে বারবার অনুরোধ করা হচ্ছে এ ব্যাপারে। আসলে, এই করোনা যতই পাওয়ারফুল হোক না কেন, ওর আসলে মানুষের মনকে বোঝার ক্ষমতা বিন্দুমাত্র নেই। তাই বোধহয় মানুষ ওকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ক্রমশ আরও কাছে পেতে চাইছে সবাইকে। আরো বেঁধে বেঁধে থাকতে চাইছে। তার উপর একটা অসহ্য বাস্তব তো আমাদের পেট। যাকে হারানোর ক্ষমতা করোনা তো মোটেই নেই। এখানেই করোনা পুরো বোল্ড আউট। যতই অন্য ম্যাচগুলোতে ফাটিয়ে খেলুক না কেন। তাই না হলে কি আর কেউ শ্মশানে মৃতদেহের কাজে ব্যবহৃত কলা এমন ভাবে লুটেপুটে খায়!
কি করব বলুন, দরজাটা তো কিছুতেই বন্ধ করতে পারছি না তালাচাবি লাগিয়ে। আর পারছি না বলেই হয়তো ভর দুপুরে চোখে পড়ে যাচ্ছে এক মা তার দুধের শিশুকে কোলে নিয়ে এসেছে কিছু শাক পাতা বেচার উদ্দেশ্যে। আসলে, উদ্দেশ্য তাঁর পেট। বাস্তব তাঁর খিদে, তাঁর সন্তানের খিদে। যা কখনো মিটবে না আমি পঞ্চাশ কি, একশ কি যতই টাকা তার হাতে দিই না কেন। যতই তার পিঠে লাঠির বাড়ি পড়ুক না কেন। আমি চাই এত সব কিছু প্রশ্ন, সমস্যার চাবি দায়িত্ব সহকারে নিয়ে রাষ্ট্র আমাদের গৃহবন্দি করুক। আমি জানি, এ লেখার পরেও আবারও কোনও দরজা খুলে যাবে, ছুট্টে যাব আমি, আর দেখব আরও এক নতুন সমস্যা।

Post a Comment

5 Comments

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো পরে,,খুব সুন্দর হয়েছে aunty,লেখার সাথে নামটা দারুন মিলে গেছে,খুলে যাচ্ছে হাজার দরজা💚👌খুব সুন্দর লাগলো👌👌

    ReplyDelete
  3. খুব ভালো লাগলো পরে,,খুব সুন্দর হয়েছে aunty,লেখার সাথে নামটা দারুন মিলে গেছে,খুলে যাচ্ছে হাজার দরজা💚👌খুব সুন্দর লাগলো👌👌

    ReplyDelete
  4. সুন্দর ভালো লেগেছে

    ReplyDelete