লকডাউনের দিনলিপি

মুখ নিজেই একটা রাষ্ট্র

সেলিম মণ্ডল


দিনযাপনের উৎসবে সাদা পায়রাগুলো আকাশ ঘিরে ফেলবে আর রাতের আকাশ হয়ে উঠবে তারাদের মেলা— সময়টা এমন নয়। সময় এখন একটা দূরবীন। ক্ষুদ্রতম নিজেকে বৃহৎ দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। আমরা সেই ক্লান্তির দরজায় দাঁড়িয়ে ক্রমাগত কড়া নাড়ছি। বন্ধ দরজা। কখন খুলবে জানা নেই। শুধুই অপেক্ষা... কখন অন্তত আকাশ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করবে। কখন বিছানায় খেলা করবে রূপসী চাঁদ। কখন তাকে জড়িয়ে ধরব। কখন ছুঁয়ে দেখব। কিন্তু এ-কেমন দিনযাপন, হসন্তের মতন শরীরে-মনে লেপটে থাকে মনখারাপ? দূরত্বের নখে নেলপালিশ চকচক করে। খারাপ আবহাওয়া খবর দেয়, তার কেটেছে। বন্ধ রাস্তাঘাট আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে নিরালায়। জেব্রাক্রসিংয়ে মাথা ঠোকে ভোরের বাজপাখি।
দূরত্ব আসলে কোনও দূরত্ব নয়। দূরত্ব হল আগামী পূর্ণিমার শুরুতে গেয়ে ওঠা একফালি চাঁদ। যা অন্ধকার মুছে আলো ছড়াতে শুরু করে। এই আলোর সন্ধানেই আমরা পথিক হতে চাই। পথ হারিয়ে আবার চেষ্টা করি নতুন পথের মোড়ে পৌঁছাতে। পথ আমাদের যৌনতা দেয়। পথের কোলে মাথা রেখে আমরা ভুলে যাই পথকষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন হল, আকাশ কই, আকাশ? মাথার উপর ছাদ, ছাদের উপর ছাদ... সিলিং, ঘুলঘুলি... বন্ধ জানালা, বন্ধ দরজা... 
রেশন দোকান থেকে আলো আসবে... সবজি বাজার থেকে আলো আসবে... মুদিদোকান তার পেট থেকে খিদে উগরে ঢেলে দেবে অপার জোৎস্না... হে প্রেমিক, কোন ইহজন্মে তুমি লুকিয়ে রাখো ঠোঁট? পাতার নাব্যতায় পাখির কোলাহল শুরু হলে, ধূ ধূ ধূলির ভিতর আমাকে ঘিরে ফেলার যন্ত্রণা কীভাবে মন্ত্রের মতো রপ্ত করব? আমার ভিতর নৌকা ভাসিয়ে কীভাবে জলের সঙ্গোপনে পোকাদের কিলবিল শুনব? একটি মাছ অজস্র মাছের মতন নিঃসঙ্গতায় জলকে ঘোলা করে। জল ঘোরে। জল পাক খায়। চোখ বাঁধ দেয় দু-পাড়ে। কালোচশমার উঠোনে শাদা বালির পলি জমে। ট্রাকের পর ট্রাক আসে। কেন আসে? আভাস পাওয়া যায়, নাগাল পাওয়া যায় না। খালি কাটা চোখে ভাসে ফাটা প্রতিশ্রুতির ভিড়। পরিযায়ী শ্রমিকের গান। নিজগৃহে মৃত্যুবরণ করার আর্তনাদ। 
যে ছেলেটি মারা গেল একা একা, তার জানাজায় নেই বিরাট কোনও শোকের আবহ, ছুঁয়ে দেখার মিথ্যা আনন্দ... যে পিতার কন্যাকে নিয়ে গেল জনা-তিনেক বরযাত্রী, যাঁর উঠোন জুড়ে নেই— কোনো এঁটো শালপাতা, নেই বাড়িময় লোকের গুঞ্জন। শুধুই শূন্যতা আর মুখবইয়ের ভিড়ে অবশিষ্ট যাপন। সাদা চুনের মতো সকাল কখন যে ভারী কোনও মোষের পিঠ হয়ে ওঠে টের পাওয়া যায় না।
আমাদের কোনও গল্প বলা দেশ নেই। আমরা যে রাষ্ট্রকে নিয়ে গর্ব করি, তার ছেঁড়া পাণ্ডুলিপিতে অনেকগুলো গল্প আছে। এই গল্পের শেষ নেই। এই গল্পগুলোতে অজস্র মানুষ হেঁটে বেড়ায় খালি পায়ে। সবাইকে বলা হয়, গৃহবন্দি থাকো। সবাই পাণ্ডুলিপি ধরে টানাটানি করে। রাষ্ট্র, মলাট দেয়। হার্ড বাইন্ড করে। আমরা পড়ি। আমরা গল্পের মধ্যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি— আমাদের দেশ বড়ো হচ্ছে। দেশের অন্নপ্রাশনে ভিড় করেছে সবুজ মাঠ, শান্ত নদী, অজস্র গাছগাছালি। কারও হাতে কোনও উপহারের বাক্স নেই। সবাই উৎফুল্লে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করছে। কোনও বাবুর্চি নেই। নেই রান্নার কোনও বন্দোবস্ত। সবাই এসেছে সবার সঙ্গে দেখা করতে। গল্প করতে। স্বপ্নটা ক্রমশ বড়ো হচ্ছে। দেশটা আরও বড়ো হচ্ছে। দিনটা আরও বড়ো হচ্ছে। ঘুম ভেঙে যায় কাচের চুড়ির মতো। হাত কেটে যায়। রক্তাক্ত সাদা ব্যান্ডেজ সকাল হয়ে ওঠে। সকালে বাবা-মা-সন্তান সকলে সকলের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। সবার মুখে বয়সের ছাপ। মুখ নিজেই একটা রাষ্ট্র।    

Post a Comment

2 Comments

  1. ভাল লাগলো সেলিম

    ReplyDelete
  2. লেখাটা নিছক একটা লেখা নয়,বাস্তবে দাড়িয়ে আবিস্কার।

    ReplyDelete