লকডাউনের দিনলিপি

দুঃস্বপ্ন কাঠবিড়ালি আর লককডাউন

শ্যামল চক্রবর্তী


আবছা অন্ধকার। অচেনা অরণ্যের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। গায়ে এসে লাগছে লতাপাতা, ডালপালা। সামনে একটা ফোঁস ফোঁস আওয়াজ। চমকে উঠলাম। একটা বিশাল চেহারার ভালুক রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে। ঘুমটা ভেঙে গেল। ভোর। কলকাতার অপার্থিব ভোর। বিছানার পাশের জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে দুস্টু লেজ নাচিয়ে ডাকছে। কাঠবিড়ালিটা বন্ধু ভাবে আজকাল। ডাকি দুস্টু বলে। উঠে পড়ি। দুস্টুকে মুড়ি দিতে হবে।
লকডাউনের ২৯ দিন। জীবন বদলে গেছে। এতকালের চেনা কলকাতাও। ‘সে অনেক বদলে গেছে, সে আর আগের মত নেই।’ রাস্তায় মানুষ নেই প্রায়। গাড়ির ভেঁপু বাজেনা আর। কেউ কৃষ্ণচূড়া অথবা জারুলের দিকে চেয়ে আছে। কেউ ফোন করছে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে। সকাল হলেই রবীন্দ্রনাথের গান বাজছে পাশের বাড়িতে। কত কতকাল পার করে কংক্রিটের এ শহর আকাশের ম্যাজিকে মগ্ন আবার। ভবঘুরেদের পাত পেড়ে খাওয়ানোর আয়োজন। গরম ভাত আর আলু সয়াবিনের ঝোল রান্না হচ্ছে পার্কের জাম গাছটার পাশে।
হাসপাতালে ঢুকতেই বিষাদ। আরও দুই তরতাজা ডাক্তার, এক সিস্টারের লালায় ভাইরাস। গাড়িতে চেপে ওরা যাচ্ছে আই ডি হাসপাতালে। আজ কতজনের পরীক্ষা হবে, তৈরি হচ্ছে লিস্ট। কে যাবে নিউ টাউন, কারা আজ গৃহবন্দি হবে। ডক্টরস ক্যান্টিনে কাগজ পড়তে পড়তে কেউ আর খাইনা টোস্ট অমলেট। কেউ হাসে না আর। মাস্কের ওপর দিয়ে শুধু জোড়া জোড়া যোদ্ধার চোখ। আউটডোরে ঢোকার মুখে স্যানিটাইজার। হাত পাতি, হাতে মাখি, রোগী দেখি। একটু দূরে দাঁড়ান ভাই। করোনার ভয়ে কাঁপে ফিভার ক্লিনিক। আইসোলেশন ওয়ার্ডের দরজায় দুই নভোচর !
‘সব বেড ভরে গেছে স্যার... দরকারে ফোনে জেনে নেব।’ ...গলাটা চেনাচেনা.. ধরাচূড়ার দিকে চেয়ে থাকি অপলক... ওই কি সোহিনী, নাকি শর্মিষ্ঠা বসু...! ‘এবার যান স্যার, থাকবেন না বেশিক্ষণ আর।’ লেবার রুমের দিকে যেতে যেতে নিজেকে নিজের কাছে অচেনা লাগছে আবার।
বিষাদ পেরিয়ে আবার অরণ্যে। হাসপাতালের ছোট্ট বাগানে ছটফট করছে বসন্ত। ঘুঘুপাখি ডেকে যায় নিঝুম দপুরে। এত সবুজ, এত চকচকে গাছের পাতা দেখছি কতকাল বাদে।  আকাশে বাতাসে এখন উৎসব শুধু। বৌহিনিয়ার উচ্ছ্বাসে ভাসে অচিন রাগিনী। প্রকৃতির জলসায় অনাহুত আমি। বেমানান।
বুকচাপা রাত্তিরে বই খুলে বসি। ‘কবিতা থেকে মিছিলে।’ বইয়ের অক্ষরমালা বুভুক্ষুর অনন্ত মিছিল। রাজপথে ত্রস্ত সাইরেন। রোগী নিয়ে ছুটে যায় একা এম্বুলেন্স। ব্যালকনির মধ্যরাতে চরাচর জুড়ে বৃষ্টি। ছেলেবেলা। ঝোড়ো হাওয়ায় দাপটে ভেসে আসছে জুনিয়র ডাক্তার দীপঙ্করের গান। ‘ভয় নেই আমরা আছি, তুমি আজ ঘরেই থাকো...।’

(লেখক আর জি কর হাসপাতালের ডাক্তার)

Post a Comment

0 Comments