লকডাউনের দিনলিপি

দিবারাত্রির গদ্য 

বেবী সাউ  


তারপর, যেন বহু বহু দূর থেকে হেঁটে আসছে সেই ধ্বনি।  সুন্দর এবং শান্ত। আমরা চুপচাপ পুবের দরজা খুলে, সমস্ত ভোরের পথ আলোর আলপনা দিয়ে ভরিয়ে তোলার চেষ্টা করি। বাবা তুলে ধরেন, ‘ওঁ জবাকুসুম...’ আমি এবং আমার ছোটবেলারা ছুটে ছুটে চলে যায় বকুলতলায়। শিশিরভেজা ফুলের সাজে উঠে আসে গ্রাম্যপথের চন্দনের মতো গুঁড়ো ধুলো এবং তার গন্ধ। সে সব গন্ধের স্পর্শ পাওয়া যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না কিছুতেই। কিছুতেই নাগাল পাওয়া যায় সেই মুহূর্তের।
অথচ, মা কী নিপুণ এবং পারদর্শীতায় সামান্য শাঁখের আওয়াজে ফুটিয়ে তুলতে পারেন একটা আস্ত মঙ্গলময় ভূমি। আমি নিরাপদ অনুভব করি। শান্ত দিঘিতে রোদ ফুটে ওঠে। নিমপাতা ফাঁকে গলে পড়ে রোদ। শুদ্ধস্বরে বেজে ওঠে জেঠিমার গায়ত্রী মন্ত্র। থামি। সত্য, সুন্দরকে উপলব্ধি করতে করতে দূরে সাইরেন বেজে ওঠে। আর তখনই  অ্যাম্বুলেন্স শব্দ এবং ভয় ভরে ছুটে চলে যায় সদর হাসপাতালে, শ্মশানে, মর্গে। পথ কী তবে বেঁকে যাচ্ছে ক্রমশ! ক্রমশ এক আশ্চর্য ভয় কাল কেউটের মতো আমাদের চারপাশের মেরুদণ্ডগুলোকে ফোঁকর করে দিচ্ছে! থামি, হাঁটি, ভয় পাই, শান্ত হই। চুপচাপ দেখি আকাশের রঙ। দেখি, সকালের রূপ কেমন দুপুরের কাঠামোয় পৌঁছায়। ডানায় বিকেলের গন্ধ মেখে ফেরে বক, ফিঙে, দোয়েল, চড়ুইয়ের দল... এসব দৃশ্যের কাছে অসম্পূর্ণ একটা উপন্যাস ঘোরাফেরা করে... অসমাপ্তও বটে! যার কোনও শুরু আছে, দু'চারটে উষ্ণ-শীতল শব্দ আছে, অক্ষর আছে--- কিন্তু গতি নেই... স্তব্ধ হয়ে থাকা এই সময়, এই যাপন মৃত্যুভয়ে কেমন যেন কুঁকড়ে আছে...।
এই কুঁকড়ে থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ আমাদের চারপাশে এখন মৃত্যুর গন্ধ। মৃত্যুর সংবাদ। অথচ প্রকৃতির দিকে তাকালে মনে হয় বিভূতিভূষণ আবার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। গাছে গাছে কত পাখি উড়ে এসে বসেছে। নাম না জানা সেই সব পাখি ডেকেই চলেছে। আমার কেমন যেন জিওভান্নি বোক্কাচিওর ডেকামেরনের কথা মনে হচ্ছে। সেই যে মহামারির সময় দশজন নিজেদের কল্পনার এক একটি গল্প বলতে শুরু করল। বাস্তবের রূঢ় জঘন্য অন্ধাকারাচ্ছন্ন মৃত্যুর পথ থেকে সরে গিয়ে তারা একে অপরকে শোনাতে শুরু করল এক একটি কল্পনার জগতের কথকতা।
হয়তো নিজেদের মনকে এভাবেই নিজেদের মনের ভিতরে নিয়ে যাওয়াই ভালো। যেখানে অপেক্ষা করে থাকে মনের ভিতরের নানান ঘর, নানান গ্রাম, নানান আলপথ, নানান গলি। যেখানে হয়তো কিছুই হয়নি কোথাও। মানুষ আগের মতো একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে। আমরা নির্ভয়ে প্রকৃতির দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে পারছি। বাংলার নিজস্ব গন্ধ, নিজস্ব ঘ্রাণ, নিজস্ব মন্থরতা যেন কড়া নাড়ছে সেখানে। প্রকৃতিও হয়তো তেমনটিই চান। আর তাই প্রকৃতি আমাদের সাবধান করে দিচ্ছেন মানুষের সঙ্গে মিশো না। বরং প্রকৃতির সঙ্গে একাকী আলাপ করো। কথা বলো। মানুষ বিপজ্জনক্। যদি ভালো করে বেঁচে থাকতে চাও, তবে প্রকৃতির কাছে এসো। একা। তোমার প্রকৃতিকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। প্রকৃতি তোমার মা।
তাও দৃশ্য  পাল্টায়, তাও একটা শুরু তৈরি হয় আপনা আপনি। যেমনভাবে, আমাদের উঠোনের একপাশে একটি তরতাজা গোলাপের গাছ। সুমধুর শব্দে বেজে ওঠে তার ফুল ফোটা, ঝরে যাওয়া পাতা এবং রোজনামচার গল্প। তার নীচে, এই সময়টাতে পেতে রাখা হচ্ছে একটা সরু কাঠির মাদুর। চায়ের কাপে ঢুকে পড়ছে সকালের মৃদু রোদ। একদিন লক্ষ্য করে দেখি, ছোট দুটি পাখি। টুনটুনি। তারা বিরাট এই শব্দের রাজ্য থেকে তুলে এনেছে প্রেমের উপাখ্যান। আর তাই দিয়ে  তৈরি করেছে ঘর। ঘরে ছোট্ট তিনটি ডিম। চা খেতে খেতে এই অবসর সব দেখে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিতে চায়। আর এখানে মৃত্যুর শব্দ নেই বরং জন্মের আনন্দ আছে। মুক্তির অপেক্ষা আছে। দেখা হয় রোজ। কাল সকালে হঠাৎ খুব চেঁচামেচি তাদের। যেন কিছু বলতে চায়, বোঝাতে চায়। পারলে মাথায় এসেও বসে পড়ে। অকুতোভয়। দেখি, বাসাটি নীচে পড়ে। ভাগ্যিস ডিমগুলো ভাঙেনি। সাবধানে তুলে ঝুলিয়ে দিই। আশ্চর্য হয়ে দেখি, যে পাখি দুটি আমাদের একটু হাসির শব্দ হলেও উড়ে যেত, আজ কাছে গেলেও উড়ে পালাচ্ছে না! প্রকৃতি আসলে বোঝে হয়তো শত্রু এবং বন্ধুর পার্থক্য! মানুষ কী বোঝে!
রাতের গভীরে ঝিঁঝি ডাকে এখানে। আগেও ডাকত হয়তো! শোনা হয়নি। বোঝা হয়নি তাদের শব্দ, লয়, তাল। শুধু, শুধুমাত্র মানুষ সরে গেলেই একটা রাস্তা কেমন ঝরা পাতায় ভরে ওঠে! একটা ধুধু প্রান্তর সেরকম ভরে ওঠে মনোমত বৃক্ষরাজিতে। ফুল ফোটে। ঘাস গজায়।
পাখিরা, জন্তুরা ফিরে আসে। একটা ধূসর পৃথিবী ভরে উঠে সবুজ রঙের তুলিতে। শুধু অবসর চাই। অবস্থান চাই। আর তখনই যেন একটা শান্ত এবং শান্তির গন্ধ জেগে ওঠে।  আনন্দের গুঁড়ো গুঁড়ো গন্ধ। সবাই হয়তো ভাবছেন আনন্দের এই গুঁড়ো গুঁড়ো গন্ধ আমি কোথা থেকে পেলাম? আমি কি এই সময়ের নই? আমি অবাক হয়ে ভাবছি, সত্যিই তো, যেখানে মড়ক নেমে এসেছে, আর একটা মন্বন্তর কড়া নাড়ছে, সেখানে তো প্রকৃতির ঐশ্বর্যের কোনও অভাব নেই। প্রকৃতি তো ঢেলে সেজে উঠছে। তবে কি প্রকৃতিরও কিছু এসে যাচ্ছে না? এসে যাচ্ছে না ধানগাছের, এসে যাচ্ছে না ইক্ষুক্ষেতের, ডাব গাছে ঝুলে আছে ডাব, পেঁপে গাছে ফলে আছে পেঁপে, টুনটুনি পাখিটা নিজের মতো করে বাসা তৈরি করছে, কোন এক নাম-না-জানা পাখি কাকে যেন ডাকতে ডাকতে উদাস হয়ে বসে আছে গাছের ডালে। কোথাও কোনও কিছুরই কমতি নেই। ভোর অপরূপ সুন্দর হয়ে ঘুম ভাঙাচ্ছে। সেখানে কোনও আশঙ্কার ছায়ামাত্র নেই। এখন কেউ বলছে না—
‘‘And I will show you something different from either
Your shadow at morning striding behind you
Or your shadow at evening rising to meet you;
I will show you fear in a handful of dust.’’ (এলিয়ট)
বরং এখন মনে পড়ছে রবার্ট ফ্রস্টকে। মনে পড়ছে আর একটু পাতা ওল্টাই বিভূতিভূষণের, উমাপ্রসাদের, তারাশঙ্করের। কোথাও কি হারিয়ে গিয়েছিলাম আমরা? এই চরম অস্বস্তির সময়েও মনে হচ্ছে পুরনো সেই রাস্তাটা আবার দেখতে পাচ্ছি। যেখানে সুন্দর অপেক্ষা করছে। আমি যদি না যেতে পারি, তাহলেও সে সুন্দর। আমি তাকে চিনতে পেরেছি।

Post a Comment

5 Comments

  1. দুর্দান্ত। বিশ্বাস করছি আশারাও পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। আমাদের দিকে...

    ReplyDelete
  2. মন ছুঁয়ে যাওয়া প্রাণবন্ত লেখা, দরজা খুলে নতুন পুবের অপেক্ষায় ওঁ জবা কুসুম...

    ReplyDelete
  3. ভীষণ ভাল লেখা । অনবদ্য রচনা । এই গদ্যগুলো যদি ধারাবাহিকভাবে লেখা হয়, বেশ ভাল হবে ।

    ReplyDelete
  4. সুন্দর লেখা, সুন্দর অনুভব.. .

    ReplyDelete