লকডাউনের দিনলিপি

যারা খই ভাজে লকডাউনে 

সঙ্গীতা চন্দ


নিয়ম করে ডায়েরি লেখার অভ্যেস বহুদিন হল ছেড়ে গিয়েছে। ইচ্ছাকৃত, আবার অনিচ্ছাকৃতও অনেকটা। আসলে সারাদিনের মনগড়া জটিলতাগুলো এভাবে অক্ষরে-অক্ষরে বাঁধলে নিছক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে আমার ধারণা। প্রশ্ন আসে, কেন তবে লিখছি?
সকাল এগারোটার কাছাকাছি, ঘুম ভেঙে দেখি বেলার প্রায় কোয়ার্টার টাইম পার। তড়িঘড়ি দিনযাপনের মূল স্রোতে আসা উচিত হলেও নিতান্তই অলস, মন্থর গতিতে চায়ে চুমুক পড়ল! পাশের ঘর থেকে দেশ রাগ শোনা যায়...
দুপুর দুটোর দিকে, বৈশাখ মাস। দুপুরের রোদ আর আমার মেজাজ— এ দুটোর মধ্যে বেশ মিল খুঁজে পাই। কারণ, যেখানে-সেখানে অনর্থক যুক্তি খাড়া করে অন্য মানুষটির থেকে যারপরনাই অপমানিত হয়ে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে বসে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদার অভ্যেসটা রয়েছে। ক্বচিৎ নিজেকে খুব পরিণত ভেবে পারিবারিক নাট্যমঞ্চে খুব অপরিণত চালাকি-সহ অপটু কাজ করে নিজের মন-প্রাণ দুই-ই ধূলিসাৎ হয় বেজায়। যাইহোক সেসব খোরাকের উপাদান। একটা কথা বলি, যখন কেউ জানে যে, তার এই লেখাটি চারটে লোক পড়বে, দু-টো লোক সমালোচনা করবে, তখন কিন্তু সে বেমালুম সজাগ হয়ে বসে। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটছে না!
ধরে নিচ্ছি, তারা লকডাউনে খই ভেজে, ডাল-চাল এক করে আবার তা আলাদা করে। পাশের বাড়ির অনীকের রেজাল্ট খারাপ হল, কেন হল তা জেনে; পিসতুতো শ্বাশুড়ির খুড়তুতো জামাইকে কত দামের ফ্ল্যাট দিল ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে ঘাম ঝরিয়েও যে অখণ্ড অবসর উদযাপন করে, তার মধ্যেও এই লেখা অধরা থাকবে তাদের। আসলে এটা ভাবলে খানিক প্রশান্তি মিলবে এই যা! তাই লিখি!
সরঞ্জামগুলো ছড়িয়ে আছে। ছবি আঁকার। যা যা লাগে। কালির দোয়াত-কাগজ-তুলি আর মন। আসলে ছবি আঁকার জন্য যতটা প্রয়োজন প্রশিক্ষণের,তার চেয়ে ঢের বেশি দরকার মননশীলতার।
বিকেল গড়িয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ থেকেই পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে, ঘরে ফেরার গান গাইছে তারা।
দক্ষিণের বাড়ির নতুন বউটির হাতের চুরির শব্দ ভেসে আসছে। ঠাকুরের বাসনের শব্দের সঙ্গে একটা প্রচ্ছন্ন মিল আছে তার।
দূরদূরান্ত থেকেও গাড়ির কোনও আওয়াজ নেই। লকডাউন। মফস্বল!
সাড়ে তিন...ঘড়িতে, দরজার গায়ে ঝোলানো ছোট্ট পিতলের ঘট। জল পড়ে নিত্য। সিঁদুর দিয়ে কোনও এক বৃহস্পতিবার হাত বুলিয়েছে মা। অনুমান। এসব দেবতার বাতিক দেখে একপশলা ঝামেলা হল আমার, রাত্রে কথা বন্ধ থাকবে। আকাশে মেঘ জড়ো হচ্ছে। কালবৈশাখী হলেও হতে পারে। সুমনকাকু বিয়ে করেছে নতুন। ঘরোয়া আয়োজন। কারণ লকডাউন। সামাজিক দূরত্ব।
বিকেল প্রায় চারটে, পায়া ভেঙে গিয়েছে ছাদে রাখা আচারের চেয়ারটার। মা হয়তো টুকটাক বুদ্ধি বাতলাচ্ছে নিজের মনে। শব্দ কানে আসছে মৃদু। গ্রীষ্মকালীন রোদ খুব নাছোড়বান্দা হয়। কিন্তু কালবৈশাখী এলেই সেই রুক্ষ রৌদ্র যেন মায়াবী আলো হয়ে ওঠে।
এখানে এখন তাই। এই বিকেলগুলোতে প্রেমেন্দ্র মিত্র পড়া যায়। কিংবা খোলা যায় ভাস্করের কবিতা। একফালি রোদে এলিয়ে দেওয়া যায় আলমারির যাবতীয় ঘুণ ধরা বই।
বলা হয়— সাম্যাবস্থায় কিছুরই উৎপত্তি হয় না। বিনির্মাণবাদ হল টেক্সট আর অর্থের সম্পর্কের সমালোচনা। ডিকনস্ট্রাকশনের উদ্দেশ্য, কোনও প্রদত্ত পাঠ্য এবং সমগ্র ভাষ্যে যে-ভাষা ব্যবহার করার হয়,  তা জটিল এবং অসম্ভব। খুব সহজে বললে, ভাষার সঙ্গে সেই পাঠ্যের যে-ঐক্য তারই সমালোচক দৃষ্টিভঙ্গি হলো বিনির্মাণবাদ। আচ্ছা, এসব হঠাৎ কেন বলছি তার প্রশ্ন আসতেই পারে।
আসলে যা লিখছি, তা নিতান্তই তাগিদ থেকে। বিভিন্ন মুদ্রায় ভাবছি কীভাবে বিখ্যাত লেখা লেখা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে লকডাউনে   খানিক জ্যাঠাইমা গোছের লেখা কমবেশি সবাই মেনে নেয়। একটু যৌনতার সুড়সুড়ি, একটু রাজনীতির কচকচানি, ফোনে নোংরা চুটকি দেখে খাওয়ার টেবিলে তত্ত্ব কপচানো, কিংবা বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় ফোকাস বিষয়ক সমীকরণ খুঁজতে ক্লান্ত নই আমরা। ব্যস্ত বটে।
এই এখন যেমন যা লিখছি, তার সঙ্গে ‘ব্যক্তি আমি’-র বিস্তর ফারাক। যা ভাবছি তা আসলে ছদ্মবেশী আমি। ব্যাস ডিকন্সট্রাকশন! ভাষা ও ভাষ্যের বিস্তর পার্থক্য!
খোশমেজাজে খবরের কাগজ তুলে চলল বাবা। বিকেল শেষ হয়েছে অনেক আগেই। সন্ধ্যা। শব্দছক মেলাবে। উলুধ্বনি-সহ দৈবাৎ শঙ্খধ্বনি আপাতত আমার চারদিকের পৃথিবীতে লটকে আছে। প্রাচীরে ঝিমিয়ে পড়া বেড়ালটা সারা গা চেটে যাচ্ছে অন্ধকারে।
রাত্তির নামলে যত অবসাদ ঘিরে ধরে। তবে আজকাল খুব জলদিই সেই নিঝুম রাত্তির নাগালে আসে। লকডাউন! 
যাই, কোনও আত্মীয়কে ফোন করে আজকের মৃতের সংখ্যা আর সরকারি কাজ নিয়ে বিতণ্ডা করলে মন্দ হয় না। পাছে টেলিভিশন আতঙ্ক বাড়ায়!

Post a Comment

1 Comments