করোনা

করোনায় শখের হিরো

মঞ্জীরা সাহা


স্টেজের রঙিন লাইট। দর্শকের হাততালি। কোনওদিন নাটকে এক খানা পার্ট জোটেনি। শখ ছিল নাটক করার। পার্ট মুখস্থ অভিনয় শেখা বাপরে! সাংবাদিক হওয়ারও শখ ছিল। সেটাও তো অনেক ঝামেলার। জীবনের ঝুঁকি। অনেক পরিশ্রম। কালো মেঘ দেখে পাঞ্জাবি পরে দু চার লাইন কবিতা আউড়েছিল ঠিকই। কবি হওয়া হয়নি। সেসব ছেড়ে সোজা ভিড় ট্রেনে তাস খেলতে খেলতে দশটা পাঁচটার ডিউটি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের শোষণ বঞ্চনা, কথায় বার্তায় বেশ ‘নারীবাদী’ ‘নারীবাদী’ প্রমাণ করতে চেয়েছিল।  রাজনৈতিক নেতাদের খুঁত খুঁজে বার করতে পেরেও ঠিক পলিটিসিয়ান হয়ে ওঠা হয়নি। কিন্তু তাতে কি! হতাশ হলে কি চলে? সুযোগ একদিন ঠিক আসবেই আশা ছিল মনে। এসেও গেল। করোনাই সেই সুযোগ নিয়ে এলো। এতো মৃত্যু’র হাহাকারের মধ্যেও নায়ক কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক একসাথে সব কিছু হওয়ার সুযোগ এসেছে।
এ রোগ সবাইকেই গৃহবন্দি করে তুললেও প্রতিভার বিকাশ থেমে থাকবে কেন? বিশ্বজুড়ে লাখে লাখে মানুষ আক্রান্ত। মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। অসহায় মানুষ খুঁজে যাচ্ছে বাঁচার পথ। কিন্তু মজাটা হল নিজের বাড়ির কেউ এখনও করোনায় আক্রান্ত হয়নি। এই সুযোগে একটু কাব্য চর্চা হয়ে যাক। না নিজের লেখা না। এই ভয়ঙ্কর রোগটা নিয়ে কত ছড়া কবিতা মজার মজার পাঁচালী তো ফেসবুকে ঘুরেই বেড়াচ্ছে। শেয়ার করলেই হল। বা অন্য কারুর গদ্য কপি পেস্ট করে সাহিত্যিক।
সেদিন রাতে পাড়ার মোড়ে ঝগড়া হচ্ছিল জোর। খুব বেশিদিন আগে না। এই করোনা আসার আগেই হবে। কার সাথে কার? রিকশওয়ালা রাত করে বিয়েবাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। আবদার ছিল দুটাকা বেশি ভাড়া। পানের ঝোল মুখে নিয়ে ‘ট’ ‘ট’ আওয়াজ করে ‘খুব খারাপ স্বভাব তোদের’ ‘ঝোঁক বুঝে কোপ মারিস তোরা’ কথাগুলো মাঝ রাতে খালি রাস্তায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। এরকম বাক্য ভিড়ের ভেতরও শুনে থাকবেন। লোকাল ট্রেনের কামরায় ফলওয়ালার সাথে, মাছ বাজারে মাছওয়ালার সাথে, বাড়ির ঝি এর সাথে। এসব একরকম বেশ চলছিল। হঠাৎ ঘরবন্দি হয়ে পড়ে দাবি উঠল নিজেকে অন্যকিছু প্রমাণ করার।
পোস্ট করে ফেলল বাচ্চাটা ন্যাংটো হয়ে বসে আছে মাটিতে। হাতের থালাটা ফাঁকা। হত দরিদ্র মানুষের ছবি। এমন ছবি তুলতে যেতে হয় না। এরকম ছবি ভিডিও’র অভাব নেই সোসাল মিডিয়ায়। ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পরের পোস্ট। চিকেন ভর্তার রেসিপি। সাথে জিভে জল আনা ছবি। এর মাঝেই কোথা থেকে আবার লক ডাউন ভেঙে রাস্তায় ভিড়ের ছবি। সেটা দিতেই হবে। পুলিশে ফোন করার থেকে ফেসবুকে পোস্ট করলে সচেতনতার ডিগ্রি বৃদ্ধি পায়। ফেক হোক পুরনো সময়ের ছবি হোক। অন্য জায়গারটাও যদি এ জায়গার করে চালিয়ে দেওয়া যায় অসুবিধা কোথায়? আরও বড় একটা খেলা আছে। ভয় দেখানোর। নানান রকম নিউজের পেজে উপরের হেডলাইনটা বেশ পিলে চমকানো। কারণ ওটা না করলে কেউ ক্লিক করে খুলে দেখবে না। ক্লিক না করলে কোম্পানির পয়সা উঠবে না। পরে খুলে দেখা গেল, না খবরটা ঠিক সেরকম না। ওদের না হয় ভয় দেখানোটা ব্যবসা। কিন্তু আপনার কি লাভ হল ওটা শেয়ার করে?
মঞ্চ এখন রেডি। লুকিয়ে চুরিয়ে আসল বা নকল ভিডিও করে নায়ক সাজার। না খেতে পাওয়া মানুষ গুলোকে ব্যবহার করার। ভয় দেখিয়ে সং সাজার। লোকের লেখা নকল করে সাহিত্য মঞ্চের হিরো সাজার।
করোনা অনেক রকম বিপদ ডেকে এনেছে দেখাই যাচ্ছে। রোগ ব্যাধি মৃত্যু নিজের মানুষের মধ্যে দূরত্ব ভীতি অনাহার বেকারত্ব। সেসবের সাথে আরও একটা বিপদের আশঙ্কা বাড়ছে।
এই করোনার আবহেও পাশের ওয়ার্ডে ফুটফুটে সদ্যজাতর চিৎকার শোনা যাচ্ছে। আমরা নাহয় এই করোনা পর্বে শখের সাহিত্যিক কবি নায়ক পলিটিসিয়ান সমাজসেবী সাজলাম। কিন্তু ওই পরের প্রজন্ম করোনা পরবর্তী বঙ্গে ‘সহানুভূতি’ ‘ভরসা’ ‘সততা’ ‘নির্ভরযোগ্যতা’ এই শব্দগুলোকে ইয়ার্কি মজার জিনিস অথবা বাজারের প্রোডাক্ট বলে মনে করতে থাকবে নাতো? 

Post a Comment

0 Comments