সম্পাদকীয়

চোপ, লকডাউন চলছে

আবীর মুখোপাধ্যায়


লেখাটা যখন লিখছি, আনন্দবাজার পত্রিকায় আমার প্রাক্তন সহকর্মী, এই বীরভূমেরই ছেলে রোহন ইসলামের ফেসবুক পেজে চোখ গেল। কী বিস্ফোরক তথ্য! এদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা, ১ থেকে ১০০০-এ পৌঁছেছে ৮ সপ্তাহে। আর হাজার থেকে ২০০০-এ লাগল মাত্র ৪ দিন! ৯৬ ঘণ্টা! আর গোটা দেশে এখন আক্রান্তের সংখ্যা ২৩৪১!
রোহনের অঙ্কে ভুল হয়নি। ভুল আমাদের।
‘আমরা’ মানে— আমরা যারা রোজ সকাল হতেই, দাঁতে নিমকাঠি গুঁজে ঝোলা নিয়ে নানা অছিলায় বেরিয়ে পড়ছি পথে। ‘আমরা’ মানে প্রতিদিন যারা সব্জি, মিষ্টি, মাছের দোকানে লাইন দিচ্ছি। মানে, আমাদের তো রোজ বাজারে যাওয়া চাই। বাবুসোনার জন্য সাড়ে তিনশো চারাপোনা চাই, গিন্নির জন্য দেড়শো কচি-পটল চাই, মাণিকের জন্য ১০০ টক দই চাই। গোপালের জন্য দুটো নকুল দানা...। রোজ চাই! ওদিকে হাজার থেকে ২০০০-এ লাগল মাত্র ৪ দিন!
গ্রাফ বলছে, এই হারে সংক্রমণ ছড়ালে ইটালি, স্পেন, ইরান, ফ্রান্স, আমেরিকা, জার্মানিকে হারিয়ে দেব আমরা, করোনায় মৃতদের লাশের সংখ্যায়!
চা খাবেন, বাদাম বিস্কুট? বাদাম নাকি আজ শুধুই প্রজাপতি খাবেন?
কে চা খেতে চায় অথবা চা খাবে না— সেই নিয়ে মিমে মজাও পাবেন, আবার নিজে সকাল হতেই দৌড়বেন লকডাউন উপেক্ষা করে? টেলিভিশনে খবরও দেখবেন, রোজ বাজারেও যাবেন? এত পেট, এত লোভ? এই ক’দিন না হয় অ্যান্টাসিড খেয়ে ঢেকুর নাই বা তুললেন!
জানি, আমাদের অনেকেরই সকাল-বিকেল মোড়ের মাথায় জটলা না করলে ভাত হজম হয় না। হজম না হলে কি করবেন? বাড়িতে বসেই বমি করুন। নিজেকে আটকে রাখতে না পারলে ঘরে তালা দিয়ে জানলা দিয়ে চাবি ছুঁড়ে দিন রাস্তায়। মনে রাখবেন, সকাল-বিকেল আপনাদের এই মোড়ে মোড়ে জমায়েত-জটলা নিয়ত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংখ্যা। রোহন লিখেছে, ‘‘এ আশঙ্কা অমূলক নয় যে, আগামী কয়েক দিনেই করোনায় আক্রান্তের এই হার আরও কয়েক গুণ বাড়বে। আমরা যদি দ্রুত ঊর্ধ্বগামী এই কার্ভকে ফ্ল্যাট না করতে পারি, তবে এই দেশ বাস্তবিকই একটি মারাত্মক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে, মোটের উপর সবাই করোনার কোপে তাঁর কোনও না কোনও বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা সহকর্মীকে হারাবেন। এই দেশ এক অভূতপূর্ব যন্ত্রণায় কাতর হতে চলেছে। এবং এক অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক পরিণতির সম্মুখীনও।’’ আর আপনাদের জন্যই আজ হাজার থেকে ২০০০-এ মাত্র ৪ দিনে!
খুব চাপ হচ্ছে? ছোট সিগারেট চলবে? আচ্ছা ছোট থাক! আজ ছোট নয়। কিং সাইজ খান, আসুন... কি যেন বলছিলেন, হজরত নিজামুদ্দিনে তবলিগ জামাতের কথা। সরকার কেন সব জেনেও বছরের পর বছর ওদের ট্যুরিস্ট ভিসায় ভারতে কাজ করতে কোনও বাধা দিল না? সরকার কেন ১৯ মার্চ অবধি তিরুপতি-সহ মন্দিরগুলোতে দর্শনার্থীদের জনসমাগম আটকাল না? কেন সংসদ চালিয়ে গেল? কেন স্বাস্থ্যখাতে জিডিপি-র মাত্র ১ শতাংশ বরাদ্দ! আচ্ছা, এখন এ সব কি খুব দরকারি কথা। এই যে সকাল বিকেল জাহাজের খবরা-খবর করছেন— জানেন, দেশে কত ভেন্টিলেটর আছে? কত সংক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছে?
কে বিজেপি, কে তৃণমূল— কে নিজামুদ্দিনে গিয়েছিল, কে রামনবমীতে নেচেছিল— জানি না। সমালোচনা করার ঢের সময় আছে মিঞা।
এসব বুলি এখন পথে নয়, নিজের নিজের বাড়িতে, দাঁড়ে বসে আউড়ান। খাঁচা থেকে প্লিজ, বের হওয়া যাবে না!
এখন সকলকে ‘রাষ্ট্রে’র নিয়ম মেনে চলতে হবে। মনে রাখবেন, কেবল আপনার মতো এই বেপরোয়া-বেহায়া-বিশৃঙ্খলদের জীবন গোটা মহল্লাকে মৃত্যু-উপত্যকা বানিয়ে ফেলতে পারে। আপনার একদিনের অসাবধানতায়, আপনার স্ত্রী-সন্তান-বাবা-মা, বন্ধু-ভাই কেউ বাঁচবে না। আপনার ভুলে একে একে মৃত্যুদূত হানা দেবে কেবলমাত্র আপনার পরিবারে নয়— হয়তো গোটা মহল্লায়। যদি এই দেশ, এই সময় নিয়ে উদাসীন হন, এখনই দেশের পরিস্থিতি জানুন। খবর নিন, করোনায় আক্রান্ত গোটা বিশ্বের। দেশের সরকার কি বলছে খোঁজ নিন। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কি বলছেন— শুনুন। আপনি অশিক্ষিত হলে, ছেলে-মেয়েকে জিজ্ঞেস করুন। বলুন— ঘুম থেকে তুলে বলুন— ‘‘সরকার কি বলছে, একটু জানা আমাকে!’’ আর যে সব বন্ধুরা টেলিফোন করে মোড়ের মাথায় চা খেতে ডাকছে, তাদের বলুন— ‘‘চোপ, দেশে লকডাউন চলছে!’’

ছবি : পার্থ ভট্টাচার্য

Post a Comment

2 Comments

  1. যারা ছোঁয়া বাঁচিয়ে থাকতে পারছেন তাঁরা বেঁচে যাবেন।যাঁরা তা পারলেন না?যাঁরা বিভিন্ন কারণে জমায়েত করছেন এখনও তাঁদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে।হয়তো কিছু শাস্তিও দেওয়া হবে।কিন্তু অকস্মৎ লকডাউনে যাঁরা জীবিকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে প্রায় হাজার মাইল হাঁটলেন,ভুখা পেটে খোলা আকাশটাকে শেষবারের মতো দেখলেন অথবা গ্রামের দোরগোড়ায় পৌঁছে কীটনাশকের অভ‍্যর্থনায় কীটস‍্য কীটের সম্মান পেলেন,যাঁদের চাবি নেই কারণ তালা নেই কারণ দরজা নেই কারণ ঘর নেই কারণ ছাদ নেই তারা কোথায় চাবি ছুঁড়বেন? গত ১৩ফেব্রুয়ারি থেকে কতজন তখনো আক্রান্ত বিশ্বের প্রার শতাধিক দেশ থেকে আমার দেশে এসেছেন?তাঁরা কোথায়?তাঁদের পরীক্ষা করা হলেও(তর্কের খাতিরে)তাঁরা যা ছড়ালেন তার কী হবে?
    শুনলাম কিছু চিকিৎসক ও স্বাস্হ‍্যকর্মী আদালতের দ্বারস্হ কারণ তাঁদের বেশিরভাগই নিরস্ত্র(পিপিই ছাড়াই)হয়েই সম্মুখসমরে লড়ছেন।এর দায় কে নেবেন?
    এই অবস্হায় কোন সংখ‍্যা বা গ্রাফই সঠিক নয়।
    রাজনীতি এখন না করলে আর কখন?
    ঘরে থাকলে না খেয়ে মরবেন বলে অনেকেই রাস্তায় রোজকার করে মালিককে তার পাওনা দিয়ে যৎসামান্য খাবার কিনে ডেরায় ফিরছে।
    তাদেরই দলের পিছনে আমিও আছি।
    আপনারা সবাই ঘরে থাকুন।ভালো আছেন ভেবে ভালো থাকুন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Lekhak bodhay kothao eta bolenni je pasher manush tir seba korbenna. Uni bodhay bolchen je ohetuk (maane kono karon chhara/ shokher jonno/ ekni adda dite) berono uchit noy socheton manusher.

      Delete