করোনা


যা আটকাতে পারে এই মহামারী

বর্ষণজিৎ মজুমদার


বন্ধুকে কাছে রাখো! কিন্তু শত্রুকে আরো অনেক কাছে! (KEEP YOUR FRIEND CLOSE BUT YOUR ENEMY CLOSEST): এই যে এই মুহূর্তে SARS COV ২ ভাইরাসের সাথে যুদ্ধে আমরা অস্ত্রহীন, তার মূল কারণটাই হলো এই ভাইরাস এতদিন অচেনা ছিলো। কিন্তু গত চার মাসে এই COV ২ ভাইরাসকে নিয়ে সাড়া পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের শুরু হয়েছে অক্লান্ত মৌলিক গবেষণা। যার ফলে এখন আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠছে এই শত্রু কি ভাবে দেহকোষের তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে, ফুটে উঠছে তার হাত, পা, চোখ, মুখ, হৃৎপিণ্ড এবং বুদ্ধির একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি। এই ভাইরাসের কোনো অঙ্গ প্রত্তঙ্গ নেই, ভাইরাসের বিভিন্ন প্রোটিন ই তার অঙ্গ প্রত্তঙ্গ।
আর মনে রাখবেন এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে জীবনদায়ী ওষুধ কিন্তু আপনা থেকে আবিষ্কার হবে না, তার জন্য দরকার হবে ভাইরাসের অঙ্গ প্রত্তঙ্গ হিসেবে কাজ করা প্রোটিন গুলোর নিখুঁত আণবিক গঠনের ছবি, এই ছবিটা ভীষণ দরকার ভাইরাসের এই অঙ্গ প্রত্তঙ্গ গুলোকে অকোজো করে দেবার মহার্ঘ অস্ত্র বানানোর জন্য। আণবিকগঠন-জীববিদ্যা বা Structural Biology র অভূতপূর্ব প্রযুক্তি এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে ওষুধ আবিষ্কারের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।আরেকটা কথাও আমাদের মনে রাখা উচিত যে এই ভাইরাসের শক্তির মূল উৎস তার ক্ষুদ্রতা , দ্রুততা এবং নৈঃশব্দ! এই শক্তির মুলে আঘাত করার একমাত্র পথ মৌলিক গবেষণা, এবং এই মৌলিক গবেষণা ভিত্তিক তথ্য ছাড়া Antiviral পেয়ে যাওয়ার চিন্তা করাটা বাতুলতা। তাহলে চলুন দেখে নেয়া যাক কিসের ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে আগামী দিনের মহার্ঘ SARS COV ২ র Antiviral যা আটকাতে পারে এই মহামারী। দেখুন ছবি ১ এই ভাইরাস স্পাইক প্রোটিন দিয়ে দেহকোষের ACE 2 তালা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়েই ছেড়ে দেয় নিজের RNA র জিন সংকেত, কোষের প্রোটিন তৈরির কারখানা Ribosome কে হুকুম করে বানাও প্রোটিন! আমাকে বেড়ে উঠতে দাও। তৈরি হয় ORF1ab । ঠিক যেন ATM মেশিনে কার্ড এর সংকেত ঢুকিয়ে টাকা তোলার মতন। এই ORF1ab দুটো মস্ত বড় প্রোটিন, কিন্তু ভাইরাসের কোনো কাজেই লাগে না যতক্ষন না পর্যন্ত কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। গোটা প্রোটিনটা মৃত, কিন্তু প্রাণ ফিরে পায় টুকরো টুকরো হলে (বেশ একটা ভৌতিক ব্যাপার)।কিন্তু টুকরো টুকরো করবে কে?
এই ভাইরাস টি প্রখর বুদ্ধিমান, কাঁচিটিকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসে। এই কাঁচিটি ভাইরাসের একটি প্রোটিয়েজ নাম PL2Pro-3CLPro। এই টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে বেঁচে ওঠা প্রোটিন দলের একটি প্রোটিন RNA-Dependent RNA Polymerase বা RDRP। আর অন্য প্রোটিনগুলোর কয়েকটি RDRP র সহকারী আর বাকি কয়েকটি কাজে লাগে দেহের প্রতিরক্ষা কোষ বাহিনীকে ধোঁকা দিতে আর দেহকোষকে দিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নিতে। ঠিক ধুরন্ধর রাজনীতিবিদদের মতো। এই RDRP ভাইরাসের প্রাণভোমরা, কারণ এটি হাজার হাজার বার কপি করে ফেলে ভাইরাস এর RNA জিনোম কে, এক একটি কপি থেকে তৈরি হয় এক একটি জ্যান্ত ভাইরাস । আবার অন্যদিকে ভাইরাসের RNA copy ছাড়াও তৈরি হয় বিভিন্ন রকমের মেসেঞ্জার RNA, তার থেকে তৈরি হয় বিভিন্ন রকমের প্রোটিন যা RNA জিনোমের সাথে মিশে তৈরি করে নতুন ভাইরাস। এই নতুন ভাইরাস বানাবার সময় নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নেয় দেহ কোষের গলগি যন্ত্রকে চাকর হিসেবে ব্যবহার করে। সোজা পৌঁছে যায় কোষের মেমব্রেনে, মেমব্রেনের লিপিডকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজেকে ঢেকে নেয় বর্মে, আবার আক্রমণ করে নতুন দেহ কোষ কে। ঘটনা গুলো একটা ক্রাইম সিরিজের গল্পের মতো শোনালেও তার উপাদান বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরি তে সংগ্রহ করেছেন এই সাংঘাতিক মৃত্যুদূতকে ল্যাবরেটরি তে কালচার করে। আজকে এই মুহূর্তে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যতগুলো এক্সপেরিমেন্টাল ড্রাগ ক্লিনিকাল ট্রায়াল এ আছে তার বেশির ভাগ টাই টার্গেট করছে ভাইরাসের তালা চাবি, কাঁচি আর জেরক্স মেশিনকে ভেঙে দেবার কাজে। ছবি ১ এ গোটা ব্যাপারটা ধরা আছে দেখুন। ওই তালা চাবি, কাঁচি আর ভাইরাসের জেরক্স মেশিনের আণবিক গঠনের একটা নিখুঁত ছবি গত দুমাসের মধ্যে বিজ্ঞানীরা তুলে ফেলেছেন ক্রায়ো ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ আর এক্স রে ডিফ্র্যাকশন যন্ত্রেও এবং এই ছবির মাপে মাপে মিলিয়ে বুঝতে পারছেন কোন রাসায়নিক যৌগ কাঁচি বা জেরক্স মেশিনের সাথে আটকে গিয়ে যন্ত্রটাকে নষ্ট করে দিতে পারে।
Recombinant ACE2 : নকল তালা যা স্পাইক প্রোটিনের চাবির সাথে আটকে গিয়ে ভাইরাস কে আসল তালার (ACE receptor of human cell) কাছে পৌঁছতে দেবে না। বর্তমানে Phase 2 ক্লিনিকাল ট্রায়াল এ
Alpha Keto amide : CLPro কাঁচির আণবিক গঠনের সাথে আটকে গিয়ে কাঁচি কে অকোজো করে দেয়, Phase 1 ক্লিনিকাল ট্রায়ালে (ছবি ২ দেখুন )
Remdesivir: RDRP নামের জেরক্স মেশিনের আণবিক গঠনের সাথে আটকে গিয়ে নতুন RNA copy করা কে বন্ধ করে, Phase 2 ক্লিনিকাল ট্রায়াল এ। সাম্প্রতিক ফলাফল অত্যন্ত ভালো। Favipiravir: Remdesivir এর মতোই, RDRP র কপি করার কাজটা বন্ধ করে দিতে পারে, Harvard Medical School এর ক্লিনিকাল ট্রায়াল এ ভালো ফল দেখাচ্ছে, ছবি ৩ দেখুন
তবে মনে রাখতে হবে যে এটি একটি ধূর্ত RNA ভাইরাস যা মিউটেশন করে নিজের প্রোটিনের গঠনকে রদবদল করে ফেলার ক্ষমতা রাখে, সেটা হলে তখন একটা ড্রাগ কাজ নাও করতে পারে। সেক্ষেত্রে ড্রাগ পাইপ লাইন এ আরো অনেক এন্টিভাইরাল থাকতে হবে, একটা কাজ না করলে আরেকটা। এই কাজটাও হচ্ছে আণবিক গঠন এবং যন্ত্রগণক নির্ভর বুদ্ধিমত্তার ওপর ভর করে যার পোশাকি নাম Machine Driven Artificial Intelligence (ছবি ৪ দেখুন)।
এখন শুধু একটাই কথা বলে শেষ করতে চাই যে আজকে এইরকম অনেক সম্ভাবনাময় যৌগের ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে, অনেক ট্রায়াল সাফল্যের মুখ দেখবে বলেই আমি বিশ্বাস করি, এবং এই কাজ কিছুতেই সম্ভব ছিল না এই SARS COV 2 ভাইরাস কে নিয়ে মৌলিক গবেষণা না হলে। পুরোটাই করেছেন সেই পর্দার আড়ালে থাকা বিজ্ঞানীরা।


তথ্য সূত্র: নেচার , সাইন্স, BioRxV এবং প্রোটিন ডাটা ব্যাঙ্ক ফাইল

Post a Comment

0 Comments