প্রকৃতি বাইরে থেকে হাসছে
অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় (জার্মানি থেকে)
জার্মানিতে আছি বেশ কয়েক বছর, সবমিলিয়ে ইউরোপে বেশ অনেকদিনই কেটে গেল। এমনিতে ভাষার সমস্যা ছাড়া তেমন খারাপ কিছু নেই, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, সব্বাই নিজের ভাষা নিয়ে খুব গর্বিত, তবে আমরা বিদেশী বলে তাও কিছুটা ছাড় আছে, আর যদি ভাঙা ভাঙা কয়েকটা শব্দ বলতে পারি তাহলে তো আর কথাই নেই। সব্বার হাসি মুখ।
করোনা ছড়িয়ে পড়ছিল, আমরা সবাই সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ রাখছিলাম বটে কিন্তু তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি, সরকারিও না বেসরকারিও না। কিন্তু সপ্তাহ তিনেক আগে ব্যাপারটা এস্কালেট করলো জার্মানিতে, ততদিনে ইতালিতে ফ্রান্সে সংক্রমণ বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। জার্মানরা কথা বার্তা সোজাসুজি বলে, আর যা বলে তা করবে বলেই বলে, কথার কথা না। তাই যেদিন আঙ্গেলা মর্কেল প্রেস কনফারেন্সে এসে বললেন সরকার ভয় পাচ্ছে জার্মানির ৬০-৭০% লোক কোরোনাতে আক্রান্ত হতে পারে সেদিন এমন চাঁচাছোলা কথা শুনে খুব অবাক হইনি।
দেশে একটু সন্ত্রস্ত আলোচনা শুরু হল, কারণ সরকারের ঘোষণাকে এরা খুবই গুরুত্ব দেয়। এর মধ্যেই অফিস থেকে জানানো হল বাড়ি থেকে কাজ করতে, অফিসে আসার দরকার নেই, সেটা ছিল ফ্রাইডে দি থারটিন্থ, ১৩ই মার্চ। আপাতত তিন সপ্তাহের জন্যে বাড়ি বন্দি। কিন্তু সব অফিস, এ পথে হাঁটেনি। যেমন আমার বৌয়ের অফিস একটি বহুজাতিক কোম্পানি, তাদের বাড়ি থেকে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতে নিতে পরের বুধবার হয়ে গেল। বেশিরভাগ বহুজাতিকই তাই, কিন্তু জার্মান কোম্পানিগুলো আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল।
যাই হোক মার্চের মাঝামাঝি জার্মানি ইউরোপিয়ান সীমান্ত বন্ধ করে দিল, সুপারমার্কেট আর জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সব দোকান বন্ধ করে দিল। দোকান পাটে কেনাকাটার ধুম পড়লো। খবর যেমন দেখলাম টয়লেট রোল নিয়ে মারামারি কিংবা শূন্য তাকের সামনে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধদের কান্নাকাটি, সেরকম কিছ কোথাও দেখলাম না। তবে সুপারমার্কেটের তাক পুরো খালি এ জিনিস জীবনে প্রথম দেখলাম। হ্যাঁ টয়লেট রোল সব হাওয়া, হ্যান্ড স্যানিটাইজার নেই, এই সব মার্চের মাঝামাঝি। তার সঙ্গে শুকনো খাবার যেমন পাস্তা, নুডলস, চাল এসব শেষ। আমরাও বেশ কিছু জিনিস কিনে আনলাম। তখন চারিদিকে চাপা টেনশন ছিল বটে, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আমরা খুব ভয় পাইনি। জার্মানি নিয়মনিষ্ঠার দেশ। লাল সিগনালে রাস্তা পার হবার জন্যে বাচ্চাকেও বগলে ফুটবল নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখেছি আমরা, যদিও রাস্তায় একটিও গাড়ি ছিল না, এরা নিয়ম থাকলে তা মেনেই চলে।
পরের সপ্তাহ আসতে না আসতেই লকডাউন, অবশ্য বাইরে বেরোনো বন্ধ না, দু জন একসাথে বেরোতে পারে, সোশ্যাল ডিসটেন্স রেখে, অর্থাৎ মিটার দুয়েক। বাইরে বেরোনো মোটামুটি বন্ধ হল, তখন আমার দেশে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষজনের কান্ডকারখানা দেখে রাগে গা জ্বলছে, আর দেশের বাড়িতে বাবা মা কে যতটা সম্ভব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি।
বাড়ি থেকে কাজ মানে অফিসের কাজ কিছুই কমলো না, বরং এলোমেলো হয়ে যায় দিনগুলো, খাওয়ার সময় থাকে না, বানানোর সময় ও। তার থেকে অফিসে যাওয়াই প্রেফার করি, আর আমার অফিসে যাওয়ার রাস্তাটা এখানকার বিখ্যাত ইংলিশ গার্ডেনের মধ্যে দিয়ে গেছে, নানা ঋতুতে শহরের মধ্যেই প্রকৃতির দেখা পাওয়া যায়। আমরা ঠিক করলাম প্রতিদিন বিকেলে অন্তত আধঘন্টা হেঁটে আসব। প্রথমদিন বেরিয়েই দেখি বাড়ির পাশের পার্কে সরকারি নোটিশ লাগানো, কি করা উচিত তা নিয়ে। রাস্তায় গাড়ি নেই, আধ ঘন্টায় ফুটপাথে জনা তিনেকের বেশি লোক পেলাম না। তাও তারা সবাই জগিং করতে বেরিয়েছে। এরকম দিন তিনেক করার পরে ইতালির অবস্থা দেখে আমরাও ঠিক করলাম দরকার না থাকলে বাইরে বের হব না।
চারিদিক নিঃস্তব্ধ, সেটা যদিও নতুন কিছু না, কিন্তু খেয়াল করে দেখলাম দূরাগত গাড়ির যে মৃদু আওয়াজ আসতো তা নেই। লোকজনকে বাড়ির ব্যালকনিতে বেশি দেখা যাচ্ছে। সপ্তাহখানেক পরে আবার সুপারমার্কেটে গেলাম, গিয়ে দেখি লাইন টেনে দেওয়া হয়েছে ক্যাশ কাউন্টারে, ২ মিটার দূরত্বে, যদিও কেনাকাটা করার সময়ে ডিসটেন্স রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সুপারমার্কেট আবার ভর্তি। টয়লেট রোল ও আছে, নেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার। ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম লোকজন কেমন জিনিস কিনছে, কোথাও দেখলাম না স্তূপাকার জিনিস পত্র, সাধারণত যেমন হয় তেমনই আর কি। এরই মধ্যে একজন জাপানি মহিলা দেখি লোকজনের লাইনের ছবি তুলছে, লোকজনের মুখের অবস্থা দেখে মনে হল না তারা সেটা ভালো করে নিচ্ছে, কারণ মঙ্গোলয়েড লোকজনকে লোকে এসময়ে একটু আড় চোখেই দেখছে, চাপা গলায় দু একটা জার্মান রাগী মন্ত্যব্যও কানে এল। ফেরার সময়ে দেখি পার্কে কয়েকজন ফুটবল খেলছে, দেখে বুঝলাম এরা অভিবাসী ছোকরারা। অনেক ইয়ং পাবলিকের এইরকমই মনোভাব, আমরা কিছু মানি না।
বাকি কেমন চলছে?
এটা তৃতীয় সপ্তাহ, বাড়িতে বসে বসে খারাপ খুবই লাগছে, বাইরে চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, গাছে গাছে নতুন পাতা বেরোচ্ছে, জানি শহরের বাইরের আল্পসের কোলের লেকগুলো এখন সেজে উঠছে, কিন্তু কিছু করার নেই, বাড়িতে বসে থাকা ছাড়া। আমরা মানুষেরাই নিজেদের এই দণ্ড দিয়েছি, প্রকৃতি তাই বাইরে থেকে হাসছে। লোকের মনে ভয় অর্থনীতির কি অবস্থা হবে, অফিসের ভয় লোকজন ঝিমিয়ে পড়ছে নাকি, তাই ভিডিও কলে নানারকম জিনিস করা হচ্ছে, যেমন ভিডিও কল করে ভার্চুয়াল লাঞ্চ, ভার্চুয়ালের কফি, ক্যামেরার সামনে নিজের ঘরে বসে চা খেতে খেতে অল্প আড্ডা। সত্যি কথা বলতে কি এসব ভালোই লাগছে।
এর মধ্যে জার্মান সরকার অর্থনৈতিক ত্রাণ ঘোষণা করেছে, কোম্পানিগুলো ইচ্ছে করলে তার সুবিধা নিতে পারে। মানে তাদের নিজস্ব আয় কমে গেলে সরকার তা পূরণ করবে, পুরোটা না, ৬০% থেকে ৯০%, মানে স্যালারিও লোকে ঐরকম পাবে, এর সুবিধা হল যে কোম্পানির আয় কমলে লোকজনের আয়ও কমবে, কিন্তু লোকজন চাকরি হারাবে না। সরকার এই ত্রাণ একবছর অবধি দেয়। এটা করোনার জন্যে নতুন কিছু না, সরকারের এই প্রকল্প বরাবরই আছে, ২০০৮ সালেও লোকে এর সুবিধা পেয়েছে। জার্মান এবং ইউরোপের অনেক দেশই এরকম করে, সোশালিস্ট নীতি মেনে চলে যেখানে সাধারণ মানুষের জব সিকিউরিটি অনেক বেশি।
5 Comments
এই সংকট সময়ে জার্মানির একটা স্পষ্ট চিত্র দেখতে পাচ্ছি এই লেখায়।
ReplyDeleteসুন্দর পড়লাম আর তফাৎটাও বুঝলাম।
ReplyDeleteপড়লাম, সাবললীল।
ReplyDeleteঅরিন্দমোচিত লেখা। সুস্থির একটা চিত্র পাওয়া গেল। আর বুঝলাম অনেক কিছু।
ReplyDeleteস্পষ্ট চিত্র। আমাদের দেশের মানুষের ও এক ই অবস্থা।
ReplyDelete