লকডাউনের দিনলিপি

রাতের যশোর রোড একা পড়ে থাকে

শুদ্ধসত্ত্ব ভট্টাচার্য


‘‘It is as reasonable to represent one kind of imprisonment by another,as it is to represent anything that exists by that which exists not.’’- Daniel Defoe, আলব্যের কামুর প্লেগ উপন্যাসের সূচনা।
বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে আলজেরিয়ার ‘ওরান’ বন্দরে প্লেগের আখ্যান নয়, যে গল্প বলতে যাচ্ছি তা আমাদের ২০২০ মার্চের কলকাতার।
মার্চের মাঝামাঝি থেকে ট্রেনে, বাসে ভিড় কম, বাড়ছে মুখোশধারীর সংখ্যা, আমরা বেলায় যাচ্ছি এগারোর পরীক্ষার গার্ড দিতে। ভাবছি এমন করেই চলবে সব। হঠাৎ করে ১৯ তারিখ মেয়ের বারো ক্লাসের পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেল, তারপর ২১-এ মার্চ নিজেরও জানা নেই যে আজই আমাদের আপাতত শেষ স্কুলে যাওয়া! ভিড়ে ঠাসা নৈহাটি লোকাল আজ ফাঁকা, লোকের ভয়ার্ত চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ‘‘এসেছে এসেছে এই কথা বলে প্রাণ’’ রবিবার জেনে গেলাম ওটাই ছিল স্কুলের শেষ ওয়ার্কিং ডে। জানি না আবার কবে যাবো বা আদৌ আর যেতে পারবো কিনা কোনওদিন!
লকডাউন! লক-আপ, লক-আউটের পর নতুন শব্দ সংযোজিত হল বাংলা শব্দভান্ডারে। মিথ্যা বলবো না, প্রথম সপ্তাহটা নেহাত মন্দ কাটেনি। ফ্রিজ ভর্তি বাজার, বাড়ির সবাই একসঙ্গে বাড়িতে বন্দি, একটানা স্কুল, খাতা দেখার পর পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো ছুটিটা বই পড়ে, ফেসবুক করে, ইউটিউবে সিনেমা দেখে গড়াচ্ছিলো ভালোই। জীবনানন্দের উপন্যাসগুলো আরেকবার পড়ার ফুসরত হচ্ছিল না, পড়ে ফেললাম। তার পর আবার শেষ করলাম তারাশঙ্কর। সকালে অনলাইন ক্লাসে ভূগোল পড়াই, দুপুর আর সন্ধ্যা কাটে বই পড়ে, ফেসবুক করে। বাড়ি পরিষ্কার আর মোছামুছির ধুম পড়ে যায়। রাতে এক একদিন বেরিয়ে এক দুই কিলোমিটার হেঁটে আসা নিষিদ্ধ মাদক সেবনের মতো আনন্দ বয়ে আনে। বাড়িতে কি বাড়ন্ত, মা বউয়ের থেকে  হিসাব নিয়ে কোনও দোকানে তার হদিশ মেলে ফাঁকায় ফাঁকায় তা খুঁজে বেড়াই। বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বাজারে আমি না যেন মানি ভয়!
‘‘কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নেই আর।’’ তাল কাটলো এরপর। যতদিন যায় খবরের কাগজে বাড়তে থাকে কাজহারা শ্রমিকদের কথা, পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার জমায়েতের কথা। থালা বাজানো আর মোম জ্বালানোর ভিড় ঠেলে জানান দিতে থাকে নিজের একা হয়ে যাওয়ার গল্প। বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা, প্রথম সপ্তাহে রাস্তাঘাটে, বাজারে দেখা মানুষগুলোর বেপরোয়া ভাব কমে গিয়ে মুখে কালো মেঘের মতো মাস্কের ছায়া ঘনিয়ে আসে। বাজারেও বন্ধ দোকানের সংখ্যা বাড়ে। সকাল এগারোটায় বাজার ফাঁকা হয়ে যায়। বাজারে গেলে এতোদিনের চেনা দোকানদারদের কম জনেরই দেখা মেলে। গাড়ির অভাবে বেকার হয়ে গেছেন তাঁরা, ফোনে খবর পাই। এতোদিন যাঁরা বাজারে তরকারী নিয়ে বসতো তাঁরা জীবিকা হারিয়ে সকাল থেকে বেরিয়ে পড়ে পাড়ায় পাড়ায় ফিরি করতে। পৌরসভা থেকে রাস্তা স্যানিটাইজ করতে এলে বুঝি ব্যাপার গুরুতর। রাতের যশোর রোড একা পড়ে থাকে ক্রমাগত চলে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সের হুটারের শব্দ বুকে নিয়ে।
যেটুকু বেআইনি বেরোনো ছিল, ভয়ে তাও কমতে থাকে, চারদেওয়াল পিষে ধরতে থাকে আমাদের। বাড়ির একটুকরো ছাদই এখন একমাত্র আশ্রয়। কী আশ্চর্য সৌরভে বেল, জুঁই সেখানে লকডাউনেও ফুল ফোটায়। বেগনভিলিয়ার সাদা, লাল আর হলুদ রঙে আগুন লেগে যায় ছাদময়।
কিন্তু আবার ঘরে ঢুকলেই মনে আসে আমাদের পাড়ার একপাশে নাগের বাজার, আরেকদিকে বেলগাছিয়া। দুদিক থেকেই উড়ে আসা খবর আর গুজবের স্রোত মনটাকে ভারী করে দেয়। বাড়ির চারপাশ ঘিরে ঘোষিত ‘রেড জোন’ বয়ে আনে আগত মহামারীর নির্ভুল সঙ্কেত। প্রথমদিকের সেই বই পড়া, অনলাইনে পড়ানো সবই ধীরে ধীরে বিরক্তিকর আর অস্থির হয়ে ওঠে। বাড়িতেও মেজাজটা হঠাৎ হঠাৎ খিঁচিয়ে ওঠে। কারুর বাড়ি কেউ যায় না, নিজেদের কাজ নিজেদেরই হাত লাগিয়ে করতে হয়। ফোনই হয়ে ওঠে অন্ধের যষ্ঠী। সপ্তাহে একদিন বাজার যাওয়াই যেন এখন প্রত্যাশিত মুক্তির জগৎ। সেখানেই দুচারজন চেনা লোক আর চেনা দোকানীদের সঙ্গে দেখা হয়, সাইকেলে বাঁধা ফ্লাস্কে করে আনা মোবাইল চাওয়ালার চা খেয়ে দুটো গল্প করেই আবার মুখের ওপর মাস্কটাকে টেনে নেওয়া। এরই মধ্যে কোনও কোনও দিন বিকেলে দু-এক পশলা বৃষ্টি আবার মনটাকে ভাল করে দিয়ে যায়।
টানা স্কুল চললে যে বিরক্ত হতো ক্লাস নিতে, সে আজ অপেক্ষায় কবে স্কুল খুলবে, কবে আবার দমদম স্টেশনে ছোটেলালের হাত থেকে আনন্দবাজারটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ভিড়ে ঠাসা গেদে লোকালে! অনলাইন পড়ানোর একমুখি নৈঃশব্দকে হারিয়ে দিয়ে কবে আবার রেজিস্টার হাতে ঢুকে পড়বে নাইন এ সেকসনের ঘরে!

Post a Comment

13 Comments

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. বাহ্,বিভিন্ন দৃষ্টিতে লকডাউনের দিনলিপি,এটা অসাধারণ এক দলিল হয়ে থাকছে

    ReplyDelete
  3. দারুণ লেখা গো। তুমি নিয়মিত লেখ এবার।

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোর অসাধারণ গদ্য দেখলে কলম ধরতে ভয় লাগে যে!

      Delete
  4. Oswabhabik bhabe sotti,Sir ...still ..”Choroibeti Choroibeti”..

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেই মন্ত্রেই তো পথচলা।

      Delete
  5. অসাধারণ লিখেছেন স্যার,আপনার ক্লাস করানোর সময়ের অনবদ্য কথার বান এখনও আমাদের টানে স্যার।বাড়িতে বসে আরো কিছু লেখার সম্ভার প্রকাশ করুন স্যার ভালোলাগবে।সুস্থ থাকুন,সতর্ক থাকুন। আশা করি আবার কোনো একদিন সুন্দর পৃথিবীর বুকে দেখা হবে আমাদের...

    ReplyDelete
  6. অসাধারণ লিখেছেন স্যার,আপনার ক্লাস করানোর সময়ের অনবদ্য কথার বান এখনও আমাদের টানে স্যার।বাড়িতে বসে আরো কিছু লেখার সম্ভার প্রকাশ করুন স্যার ভালোলাগবে।সুস্থ থাকুন,সতর্ক থাকুন। আশা করি আবার কোনো একদিন সুন্দর পৃথিবীর বুকে দেখা হবে আমাদের...

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধবাদ। নিশ্চয়ই দেখা হবে।

      Delete
  7. চেনা দুঃখ চেনা সুখ


    ......

    অচেনা অসুখ

    ReplyDelete