করোনা

অনেকটাই অভ্যস্থ হয়ে গেছি

অরিজিৎ চক্রবর্তী


পশু-পাখিরা হয়তো দেকার্তের মতো ভাবতে পারে না—‘আই থিঙ্ক দেয়ারফোর আই একজিস্ট’। সে কারণে তারা নিশ্চয়ই মানুষের তুলনায় ‘নিন্মচেতনাসম্পন্ন’। কিন্তু তাদের মধ্যে এমন এমন অনুভূতির সন্ধান পাওয়া যায় যা সহজেই আমাদের ঈর্ষার কারণ হতে পারে। বহু আলোচিত ঘ্রানশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তির কথা না হয় বাদই দিলাম।
সৌন্দর্যের বোধই কি মানুষের একচেটিয়া? ময়ূরীকে আকৃষ্ট করতে ময়ূর পেখম মেলে যে দৃশ্য সৃষ্টি করে তা মানুষের ভাষায় অপরূপ সুন্দর। অর্থাৎ‘নিম্নচেতনাসম্পন্ন’ প্রাণীর স্নায়ু উত্তেজিত হচ্ছে যে দৃশ্যে তা মানুষের মতো ‘উচ্চচেতনাসম্পন্ন’ প্রাণীর মনে সৌন্দর্যের সৃষ্টি করছে। ব্যাপারটা কি বিস্ময়ের নয়!
আগামী পৃথিবীর জন্য ভয়াবহ বার্তা নিয়ে প্রাণঘাতী সংক্রমণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯)। সারা বিশ্বে প্রতিদিনই সংক্রমণের সংখ্যার পাশাপাশি বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। তাই গত বেশ কিছুদিন ধরে আমরা যে বন্দিদশায় প্রায় সকলেই নিজের নিজের বাড়িতে আক্রান্ত, একঘেয়েমির স্বীকার, তাতে ব্যক্তিগত ভাবে প্রথম প্রথম বিষাদগ্ৰস্থ হয়ে পড়লেও এখন অনেকটাই অভ্যস্থ হয়ে গেছি।
এখন আমার আর অবসাদের সমস্যা নেই। বরং আমার বাড়ির চারপাশে যে বিস্তীর্ণ শালের জঙ্গল মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে— তাকে পুনরায় নতুন ভাবে অনুভব করছি। শুনছি অজস্র অচেনা পাখির ডাক। দেখছি বুনো খরগোশের চঞ্চলতা। যেন লুম্বিনী বনে গৌতম বুদ্ধের মতো শালগাছের নীচে আমার নতুন জন্ম হয়েছে। যেন আমি চেনা জীবনের বাইরে নির্বাণের অন্বেষণ করছি।‌ পশু-পাখির অধিকার নিয়ে ভাবা শুরু করেছি। প্রাণিজগতের তথা প্রকৃতির উপর মানুষের আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টা গত কয়েক শতকে পশ্চিমি সভ্যতায় যত উৎকটরূপে প্রকাশ পেয়েছে তেমনটা আগে কখনও দেখা যায়নি। কোন সমাজ বিশ্বসংসার কে কী চোখে দেখে, অর্থাৎ তাদের ‘ওয়ার্ল্ডভিউ’ কী তা জানার উপায় হলো তাদের পৌরাণিক কাহিনি, রূপকথা এবং ধর্মগ্ৰন্থ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা। বহু তথাকথিত আদিম জনগোষ্ঠী ছিল প্রাকৃতিক শক্তি ও পশু-পাখির উপাসক। প্রকৃতিকে জয় করার অপেক্ষা এদের ছিল না। প্রকৃতির সঙ্গে ঐক্যস্থাপন করেই এরা চলতে চেয়েছিল।
আমাদের বাড়ির সামনে তালগাছে দাঁড়কাক বাসা বেঁধেছে। আমি প্রতিদিন সকালে মা আর শিশু কাক গুলোকে খেতে দিচ্ছি। ছেলেবেলায় দিতাম। আবার এই মধ্য বয়সে দিচ্ছি। পথচারী কুকুরের অসুস্থতায় ওষুধ এনে খাইয়েছি। আসলে লডডাউন আমাকে সহিষ্ণুতা শিখিয়েছে। অজানা ভাইরাসের উৎকন্ঠা বাড়ছে ঠিকই। সেল্ফএমপ্লয়েড, তাই রুজিরুটিতে টান পড়েছে। রোজগার বন্ধ। তাও নিজেকে আবিষ্কার করছি প্রতিমুহূর্তে। বাড়ির যে বাগান অবহেলায় পড়েছিল— সে এখন পরিচর্যা পাচ্ছে। বিনিময়ে ভরিয়ে দিচ্ছে প্রতিদিনের রসুইঘর। টমেটো, পেঁপে, লাউ, বিনস, গাজর, লঙ্কা কিছুই যে কিনতে হয় না বাজার থেকে। প্রকৃতি ও মানুষের এটাই তো সহাবস্থান।
নেচারালিজম বা প্রকৃতিবাদ হল, একটি ধারণা বা মতবাদ যা অনুসারে কেবলমাত্র প্রাকৃতিক নিয়ম এবং বলই (অতিপ্রাকৃতিক অথবা আধ্যাত্মিক নয়) জগৎকে পরিচালিত করতে পারে। প্রকৃতিবাদকে ধারণকারী অর্থাৎ নেচারালিস্ট বা প্রকৃতিবাদীগণ বলেন, প্রাকৃতিক নিয়মগুলো হল সেই নিয়ম যা প্রাকৃতিক মহাবিশ্বের গঠন ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং পরিবর্তিত মহাবিশ্বের প্রতিটি ধাপই এই নিয়মগুলোর ফলাফল হয়ে থাকে। হয়তো আমরাও এরকম কোন ফলাফলের দিকে এগোচ্ছি। ইতিহাস তো মৃতসভ্যতার পরিকীর্ণ ধ্বংসস্তূপ। টয়নবির ‘স্টাডি অফ হিস্ট্রির’ প্রতি খন্ডে তার কঙ্কাল ছড়ানো।
করোনা পরবর্তী সময় শুধু গণতন্ত্র নয়, জাতীয় সত্ত্বার সংকটও বলা চলে। তাই আমাদের তৈরি করতে হবে মানুষ ও প্রকৃতির উপাসনাগার। হাতে হাত রেখে এগিয়ে যেতে হবে। অনেক পরিশ্রম তাতে, অনেক বাধা— কারণ সৃষ্টির পূর্ব লগ্নেই গর্ভযন্ত্রণা।

Post a Comment

4 Comments

  1. অসাধারণ অনুভূতি । এবং এই উপলব্ধি খুবই জরুরী । কিন্তু মানুষের এটা হবে বলে মনে হয় না । কিছু না , যাদের বাড়িতে একাধিক পেট্রোল ডিজেলের গাড়ি আছে তারা একটা কমাবে কি ? ফ্রিজ , এ সি সবকিছুতেই বিপদ । গ্রিনহাউস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ।

    ReplyDelete
  2. জরুরী এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ

    ReplyDelete