লকডাউনের দিনলিপি

এখন ভয় পাওয়া দরকার

পার্থ সারথি চক্রবর্তী


সত্যি দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েক সপ্তাহ। ঘরে বসে থাকতে থাকতে কিন্তু কিছুটা হতাশাও গ্রাস করতে শুরু করছে অনেককে। সাংসারিক জীবনে নানারকম চিন্তা ও চাপ সর্বদাই আমাদের উপরে কাজ করে। তবে সেটা যখন খানিকটা অন্য ভাবে আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে তখন সেটা একটা অন্য মাত্রা নেয়। হ্যাঁ সেটা ভয়। আমদের জীবনের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী এই ভয়। আমরা প্রত্যেকেই ভয় পাই। খুব ছোটবেলা থেকেই আমাদের মনে এই ভয়ের সঞ্চার হয়ে থাকে। আমরা কিছু ভয় নিয়ে জন্মাই আর কিছু ভয় আমরা শিখি। যেমন পরীক্ষায় ভাল ফল করা, অন্যের থেকে কম নম্বর পাওয়া এসব দিয়ে ভয় শুরু। পড়ার শেষে কেরিয়ার গড়ার ভয়। আবার কর্মক্ষেত্রে সেটা টিকিয়ে রাখার ভয়। স্নায়ুবিজ্ঞান বলছে, আমরা এমনি এমনি ভিয় পাই না। আমাদের মাথায় টেম্পোরাল লোবের মধ্যে আমন্দ বাদামের মত দুটো ডিভাইস থাকে। যার নাম অ্যামিগডালা, সেখান থেকে ভয় নামক অনুভুতির জন্ম হয়।
মনোবিদের কথায়, ভয় আমাদের দুর্বলতা নয়। ভয় আমাদের টিকে থাকতে সাহায্য করে। ভয় আমাদের সাবধানী করে তোলে। এই সহজাত ভয় না থাকলে আমরা বেপরোয়া হয়ে উঠি। সমাজের কোনও বাধা থাকে না আমাদের সামনে। আমরা মানতে চাই না কোন সীমারেখা। ন্যায় অন্যায় বোধ হারিয়ে যায়। ভারসাম্য হীন হয়ে পড়ে শালীনতা বধ।
ভয় মোটামুটি তিন রকম। প্রথম ব্যাথার ভয়। ব্যাথাকে ভয় করি বলেই আমরা দশ তলা থেকে লাফ দিই না, যা ইচ্ছা তাই করতে পারি না। দ্বিতীয় ভয় হল পড়ে যাবার ভয়। আর তৃতীয়ত আচমকা চিৎকারে বা আওয়াজে ভয়। নতুন কিছু মানেই, আচমকা কিছু ঘটে যাওয়া মানেই ছটফটানি শুরু। যেমন ধরা যাক এক কর্মক্ষেত্রে নোটিস এল যারা ভাল কাজ করবে না তাদের ছাঁটাই করা হবে। এর পর কিন্তু সকলের আচরণের অসাম্য দেখা দিতে বাধ্য। কিছু কর্মচারী নিজের কাজ আর ভালভাবে করার চেষ্টা করবেন। কেওবা যাবেন বসের কাছে প্রশ্ন করতে যে ভাল কাজ করা সত্বেও কেন তারা এমন নোটিস পেলেন। এটাকে বলে লড়াই করা। আর কিছু মানুষ এটা নিয়ে আর কিছুই বলবেন না। রোজ এক ভয় নিয়ে কাজে আসবেন, সন্ত্রস্ত হয়ে থাকবেন ও বাড়ি ফিরে জাবেন। যা কিনা দীর্ঘমেয়াদী ভয়। আর এ থেকে জন্মায় হতাশা, নেগেটিভ মানসিকতা, ডিপ্রেশন। ধীরে ধীরে ওই হতাশা গ্রাস করবে জীবনের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকেও। আবার কনডিসনাল ভয় আসে প্রত্যাশার চাপ থেকেও। আবার কিছু লোকের ভয় খুব বাস্তবসম্মত। যাকে বলে রিয়াল ভয়। প্রিয়জনকে হারাবার ভয়, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার ভয়, পরিবারের থেকে দূরে থাকার ভয় ইত্যাদি।
গত মাস তিনেক ধরে গোটা বিশ্ব এই ভয়ে আক্রান্ত। যে মহামারি তান্ডোব চালাচ্ছে পৃথিবীতে তাতে প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ আজ ভীত। হাতে গোণা কয়েকটা দেশ ছাড়া সবাই এর প্রকোপে থরহরিকম্প। কি হয় কি হয় ভাব। এই ভয়তা কিন্তু রিয়াল ভয়। মনোবিদের ভাষায় এটা কিন্তু খুব জরুরী এবং উপকারিও বটে। তারা কিন্তু ভয়কে দুর্বল ভাবতে নারাজ। এই ভয় কিন্তু বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। কেন না এই ভয় আছে বলেই আমরা স্বেচ্ছাছারিতা করতে কিছুটা হলেও বিরত হই। ভয় আছে বলেই আমরা হারতে চাই না। আমরা শেখার চেষ্টা করি। ভয় কে জয় করার দুটো রাস্তা— একটা হল এড়িয়ে যাওয়া আরেকটা হল মোকাবিলা করা। আর ঘটনাক্রমে যখন দুটো রাস্তা মিলে যায়, তখন তো আর ভাবার কোন অবকাশ থাকে না।
একবিংশ শতকে এসে গোটা বিশ্বকে এক লাইনে দাড় করিয়ে দিয়েছে এই অভূতপূর্ব অসুখ। তাও যেমন তেমন অসুখ নয়, একেবারে মহামারি। একে এখন ভয় পাওয়াটা ভীষণ জরুরি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, যতটা সম্ভব ঘরে থেকে, ভয় করেই লড়তে হবে আমাদের। কারণ এখনও হাতে নেই কোনও মারনাস্ত্র— যা দিয়ে একে হারানো সম্ভব। আমরা বেঁচে থাকি কমবেশি চার হাজার সপ্তাহ। তার মধ্যে ছয় থেকে আট সপ্তাহ এই অজানা অসুখকে ভয় পেলে আখেরে মানবজাতির মঙ্গল। মানব সভ্যতার মঙ্গল।
এই ভয় কিন্তু আমেরিকা পায়নি বা পেতে চায়নি। এখন ভারতের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ব্রিটেন সহ দেশগুলো ভয় পেতে চায়নি তার মাশুল দিয়ে যাচ্ছে। এখন ভয়কে সমীহ করেই তাকে জয় করা সম্ভব। ভয়ের বিনিময়ে সময় কিনে বের করা সম্ভব কোনও উপায় বা ভ্যাকসিন।
সব দেশেই মৃ্ত্যু ভয়ের সঙ্গে রয়েছে কাজ হারানোর ভয়। জীবিকা হারানোর ভয়। অর্থ-সংকটের ভয়। মনে রাখা দরকার, মহামারির ভয়টা কিন্তু মাথায় থাকা আবশ্যক। কিন্তু বাকি ভয়গুলো যেন সেই ভয়কে ছাপিয়ে না যায় সেটা নিশ্চিত করাও ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন। নাহলে কিন্তু প্রথম ভয় গৌণ হয়ে যাবে বেঁচে থাকার ন্যুনতম শর্তগুলো পূর্ণ হবার কাছে, জীবন জীবিকা রক্ষা করার কাছে। আর  সেটা আটকাতে পারলে হয়তো আমরা নাগরিকরা পারব না এই মহামারির কবল থেকে নিজেদেরকে, সমাজকে ও দেশকে রক্ষা করতে।

(লেখক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থ দফতরের, কোচবিহার জেলার দায়িত্ব প্রাপ্ত আধিকারিক) 

Post a Comment

0 Comments