লকডাউনের দিনলিপি

মানুষ একবার জন্মায় না

সৈকত বালা



একদিন সত্যি সত্যিই রবীন্দ্রভবনের গেটে ঝুলতে দেখলাম ভবনের অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঘুমিয়ে পড়ার বিজ্ঞপ্তি। আর তারপর থেকেই যেন ধীরে ধীরে প্রগাঢ় সুষুপ্তি নেমে এলো চারদিকে, কেউ কোত্থাও নেই। পথের ঘূর্ণিতে একটা শুষ্ক বটপাতা হয়তো বা উড়ে গেল কিছু দূরে। ‘দূর’ এই শব্দখানি ভোরের আবছা স্বপ্নের মতো শোনায় এখন, কোনও এক ভবিষ্যতে তা সত্যি হবে বটে তবে সুদূর না অদূর তা বলা যায় না। বস্তুত বসন্তোৎসবের দিন ট্রেনটা বোলপুর ছেড়ে যাওয়া মাত্রই সব কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল, ফোনটা তুলে নিয়ে বাড়িতে বললাম— ‘মা আমি কালকেই ফিরছি’। আর তারপর থেকেই ক্রমশ রোমন্থন। সমগ্র চেতনা জুড়ে শুধু একটিই শব্দ খেলা করে—‘মনে পড়ে’, আর কানে ভেসে আসে ঢিলে হয়ে যাওয়া সাইকেল চেনের একঘেয়ে শব্দ।
দেড়টা বাজলেই ভাষা বিদ্যাভবন থেকে কয়েকটা সাইকেল দুদ্দাড়িয়ে সোজা মেলার মাঠকে আড়া আড়ি চিরে দিয়ে বামে সরু গলির মধ্যে কিছুদূর এগিয়ে এক্সিস ব্যাঙ্কের এটিএম টাকে ডাঁয়ে রেখে সটান চলে যায় পাকা রাস্তা পেরিয়ে হিন্দি ভবনের পাশে ক্যান্টিনের লাইনে। বড্ড খিদে পেয়ে গেছে আর হাতে একগোছা টাকা। সব আমার না, যখন যে সঙ্গে থাকে তার, কখনো বা অন্য বিভাগেরও পরিচিত কারোর। লাইনে যে থাকে তার হাতে কুপনের টাকা, আর বাকিরা ইতিমধ্যে ছড়িয়ে গেছে টেবিলে, জায়গা ধরতে হবে তো নইলে এক্ষুনি বোঝাই হল বলে! আর যেদিন চোখের দেখাতেই বলে দেওয়া যায় আজ ‘লাইনেই আছি বাবা’ এই বোধের জাগরণ ঘটবে, সেদিন চলো পিপিলিকা!
আড়াইটা থেকেই আবার ক্লাস শুরু, কিন্তু আমার আবার খাবার পর যে আশ্রম চত্বরে গিয়ে একবার মন্থর গতিতে টহল না দিলে চলে না। কিন্তু পিপিলিকাতে এলে ক্লাসে দেরীতে পৌঁছনো কে আটকায়! আর দৈবাৎ যদি আমার মতো অন্য কোন জ্ঞান পাপী কে দেখি, পারলে তার জামার কলারে ছাতার হাতলের বাঁকানো অংশটা আঁকশির মতো করে ঢুকিয়ে পেছন দিকে টেনে রাখবো সেও ভালো তবুও একা একা নীড়ে ফিরতে দেব না, কখনোই না! অগত্যা যতক্ষণ না ক্লাসে দাদা গম্ভীর মুখে একটা ছোট্ট ইন্টারভিউ নেবার পর বলেন যাও বোসো; ততক্ষণ পর্যন্ত একটা অদ্ভুত ঠেলাঠেলি চলতেই থাকে।
তবে সব থেকে বড় ব্যাপার বাড়িতে আধঘণ্টা বসে খাওয়া ছেলেটা এখানে এসে পাঁচমিনিটেই খাওয়া শিখে গেল, আর রান্নায় হল একেবারে টেসলা কিম্বা এডিসনের গবেষণা তুতো ভাই! এক হাতে জীবনানন্দ, শঙ্খ, বিনয় আর অপর হাতে খুন্তি। কখনও ডানহাতে রামমোহন কে রেখে আড় চোখে কড়াইয়ের দিকে চেয়ে বলি এবার লেখো তো দেখি বেরাদর বেগুনভাজার সহিত বিচার!
সাইকেল নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘোরা, মনখারাপ হলেই কোনার্ক বাড়ির আনাচে কানাচে অতৃপ্ত আত্মার মতো এঘর ওঘর টহল দিয়ে ফেরা অথবা একলা শালবন আর রোজের আম্রকুঞ্জ এখন আমাকে ছাড়াই দিব্য আছে। শান্তিনিকেতন গৃহের উপরতলায় উঠে খড়খড়ির পাল্লাওয়ালা খোলা জানালা দিয়ে অনেকদিন সামনের ওই বিস্তৃত পথখানি আমি দেখিনি। উপাসনা গৃহের দরজা বন্ধ। অনেকদিন বাড়ির সামনের ওই রামকিঙ্করের ভাস্কর্যটার দিকে হাঁ হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা এই ভাবিনি, এটি কি হতে চেয়েছিল, কিম্বা আরো কি কি হতে পারে! বস্তুত এই আচমকা স্তব্ধতায় মধ্যে মধ্যে এখন সমগ্র শরীরের তন্ত্রী জুড়ে এক অদ্ভুত অনুরণন ছড়িয়ে যায়, তানপুরারর মন্দ্র সপ্তকের তারে যেন হাত পড়েছে, ও কম্পন সহজে থামে না! মন এখানে দ্রব হয়ে আছে, সর্বব্যাপী সর্বগম্য সত্ত্বার নীচে এই অনন্ত জলে শুয়ে শুয়ে টের পাই, প্রকৃত পক্ষে এখানে মানুষ একবার জন্মায় না, প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।

Post a Comment

2 Comments

  1. যেন ফিরে গেলাম নীড়ে

    ReplyDelete
  2. স্মৃতিমেদুর। ভালো লাগলো লেখাটা😊

    ReplyDelete