সম্পাদকীয়

ভোটার তালিকা ছোট হয়ে যাবে নাতো

আবীর মুখোপাধ্যায়


ধূপ-ধুনোর ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে চতুর্দিক। চণ্ডীতলার থান, গাছপালা, বনবাদাড়— আকাশ— চরাচর। সুগন্ধে মাতোয়ারা পুজোতলায়, ভিড়ের জনতা অদৃশ্য মন্ত্রে যেন থমকে গিয়েছে! জোড় হাত করে মিটমিটিয়ে চেয়ে সবাই।
  চারিদিক সুকঠোর নিস্তব্ধতা, ফিসফিসিয়ে কথা বলাও বারণ! কেবল থেকে থেকে পুরোতমশাই তারস্বরে চিৎকার করছেন— ‘মা, মা—দেখিস মা!’
  এই বলতে বলতেই ঠাকুরের মাথা থেকে টুপ করে একটি পদ্মফুল গড়িয়ে পড়ল। আর অমনি বেজে উঠল ঢাক-ঢোল। সমস্বরে ভক্তকূলের জয়রব! অশ্রুসজল চোখে সিঁদুর লাগানো ফুল-বেলপাতা মায়ের শ্রীচরণ থেকে তুলে ভক্তের হাতে দিলেন পুরোহিত।
  গাঁ-ঘরে বড় হওয়ার সুবাদে এ দৃশ্য খুব খুব ছোটবেলায় দেখেছি। দেখেছি একটুকরো পুষ্প-প্রসাদের জন্য হাজার মানুষের আকুতি। শুনেছি, দেবতার মাথা থেকে, বিশেষ বাসনায় নিবেদিত ফুল পড়ল—কি—পড়ল—না, সেই নিয়ে গঞ্জে ফিরিস্তি! এতদিন পর আরও একবার দেখলাম ফুল পড়া কাকে বলে! ‘ফুল পড়া’ নিয়ে মুলুকজুড়ে হাওয়ার হল্লা!
  সংবাদমাধ্যমে দেখলাম— করোনা সৈনিকদের কুর্নিশ জানাতে আকাশে চক্কর কাটছে কপ্টার ও যুদ্ধবিমান। আকাশ থেকে ফুল পড়ছে করোনা হাসপাতালগুলির উপর। ভাবলাম, ঈশ্বর আছেন— এমন দুঃসময়ে তিনি সাড়া দিয়েছেন। নিজের অজান্তেই হাতদুটো জড়ো হয়ে কপালে উঠে গেল সেই অদৃশ্যকে কুর্নিশ জানাতে। কিন্তু ভুল ভাঙল অনতিপরেই। জানতে পারলাম, নোভেল করোনার প্রকোপে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও প্রায় প্রতিদিনই নয়া নজির তৈরি হচ্ছে দেশে। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মী-আধিকারিক, সেনা বাহিনীর জওয়ান এবং সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের অভিবাদন জানাতে দিনকয়েক আগে পুষ্পৃষ্টি-সহ একাধিক পদক্ষেপের ঘোষণা করেছিলেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত। সেই মতো রবিবার সকাল থেকে ফুল পড়ছে দেশজুড়ে! আর সেই নিয়ে হই রব নেট-এ-বাজারে! জয়রব নয়, খেউড়ে ভেসে যাচ্ছে বায়ুসেনার উদ্যোগ। এমন অপচয়ে অতি হনুর দলও তেড়ে সমালোচনা করছে। সেটাই স্বাভাবিক নয় কি?
  দেশে সব রাজ্যে এখনও টেস্ট কিট ও পিপিই-র জোগান নেই— ১০০ কোটি উড়িয়ে দিলেন? বলেহারি ‘দেশভক্তি’ মশাই! খরার দিনে ফুলের যোগান না থাকলে দেখতাম পুরোহিতরা পরম দেবভক্তিতে ধান-দুব্বো-তুলসি দিয়ে পুজো সারত। ঠাকুরের মাথা থেকে ফুল নয়, পড়ত ঘাস-পাতা। দুর্দিনে কখনও সেটুকুও বাড়ন্ত হলে, নিত্যপুজোয় নিবেদন হত হৃদয়-শব্দ। তবু এমনতরো ‘ফুল খেলার’ বিলাসিতা দেখিনি! করোনার মতোই যেন ছোঁয়াচে ‘ফুল খেলা’র বিলাস! রবিবারই হাওড়ার টিকিয়াপাড়ার মানুষ লকডাউন উড়িয়ে বাড়ির ছাদে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুলিশের ওপর পুষ্পবৃষ্টি করলেন! প্রায় মিছিল করে বোঝাতে চাইলেন, কয়েকদিন আগে পুলিশের ওপর হামলায় তারা অনুতপ্ত!
  রি-ট্যুইটে দেখলাম, ইন্তেখাব আলম নামের এক ব্যক্তি একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছেন। একহাতে সন্তানকে কোলে নিয়ে, জিনিসপত্র টানতে টানতে এগিয়ে চলেছে এক মহিলা। ইন্তেখাবের প্রতিবাদ— ‘‘একশো কোটি খরচ করে সরকার যখন মনোরঞ্জন করতে ব্যস্ত, তখন ১০ মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে সুরত থেকে হেঁটে ইলাহাবাদ যাচ্ছেন এই মহিলা।’’ ফুলের বদলে না হয়, পাশে থাকার ‘আশ্বাস’ দিতেন বিপিনবাবু! লাইভে দেখলাম, সল্টলেকে একটি হাসপাতালের বাইরে আকাশের দিকে তাক করে ক্যামেরা-কলম উঁচিয়ে একদল সংবাদ-কর্মী। দেখতে দেখতে মনে হল, নজর ঘুরে যাচ্ছে নাতো? কে কার সমালোচনা করবেন— হররোজ পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন বনাম ফুল খেলা!
  কত মৃত্যু, কত সংক্রমণ, কিসে মঙ্গল— এসবের থেকে একটু একটু করে পিছু হটে, এখন রাজ্য বনাম কেন্দ্র, চিঠি বনাম চিঠি, চাল বনাম চালের রাজনীতিতে মজেছি আমরা!
  দিনভর ফেসবুকের ফাজলামি সরিয়ে কখনও সখনও ফরিস্তা-ফিড এসে থামছে। জরুরী সেই সব পোস্ট যত পড়ছি— ভয় হচ্ছে! ছোটবেলায়, দেবতার মাথা থেকে ফুল পড়ার পিছনে পুরোহিতের কারসাজি জানতে পেরে যেমন বিশ্বাস ভেঙে গিয়েছিল— তেমন ভেঙে যাচ্ছে ভরসার দালানকোঠা!  কেবলই মনে হচ্ছে, কেউ বা কারা কি আতঙ্ক ছড়াছে?
  না— ছাই চাপা আগুনের তাত ছড়িয়ে পড়ছে হাওয়ায়। পড়শি জেলা থেকে লকডাউনে ছাড়ের খবরে তাই ‘আনন্দ’ নয়, অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠছে বুক। নির্বাক হয়ে যাচ্ছি, স্রেফ জনাদেশ-স্বার্থে ধর্মীয় জমায়েত বা মিছিল হচ্ছে এখনও, এই সংকট দিনে। বিশ্বের সবকটি দেশের জনঘনত্ব আর করোনায় মৃতের হার দেখে নিজের দেশ-রাজ্যের হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে।
  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে গত ৪৪ দিনে এ দেশে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় ৪৪ হাজার ছুঁই ছুঁই!
  মহামান্য সরকার বাহাদুর, ভোটার তালিকা ছোট হয়ে যাবে নাতো!



Post a Comment

0 Comments