ব্লগ : হ্যালো হান্ড্রেড/ ১

হ্যালো হান্ড্রেড/ ১

দ্যুতিমান ভট্টাচার্য


উফ্‌! ক্যাকটাসের কাঁটা ফুটলে ব্যথা স্বাভাবিক। ব্যথা মানুষকে সজাগ রাখে। পরবর্তী ব্যথা থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে শেখায়। সচকিত হয়ে হাত সরিয়ে নেয় ধীমান। তারপর চোখ ছোট ছোট করে বুড়ো আঙ্গুলের ওপর থেকে চিমটে দিয়ে সরু কাঁটা টেনে বের করে। স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই তারপর বুড়ো আঙুল চুষে নেয় সে।
ধীমান এসডিপিও। আদ্রার বাংলোর বারান্দায় সারিবদ্ধ ক্যাকটাস। প্রতি রবিবার সকালে নিজের ক্যাকটাস কালেকশন পরিচর্যা করে। মরুভূমিতে যে গাছ অনাদরে জন্মে, আমাদের ঘরের শোভা বর্ধন করে সে। ধীমান একমনে একটা সরু কাঠি নিয়ে ক্যাকটাসের গা থেকে মাকড়শার জাল সরায়।
উদ্ভিদবীদ ক্যারোলাস লিনিয়াস। ক্যাকটাসের নামকরণ করেছিলেন। গ্রিক শব্দ ‘ক্যাকটোস’ থেকে। যার অর্থ কাঁটায় ভরা। কাঁটা আত্মরক্ষার হাতিয়ার। কাঁটা সাবধান করে।
টবে লেবেল লাগিয়ে রাখা রকমারি ক্যাকটাস। এপিফাইলাম, গোল্ডেন ব্যারেল, ওল্ড লেডি, সেরেয়াস, ফণীমনসা, মিল্ক ট্রি। দীর্ঘজীবী গাছে ফুল আসে। মাঝে মাঝে। সময়ান্তরে। সে ফুলের সৌন্দর্যই আলাদা। তবে ক্ষণস্থায়ী। দু-একদিনের মধ্যেই ঝড়ে যায়।
পকেটে রাখা মোবাইলটা হঠাৎ ভাইব্রেট করে ওঠে। চমকে গিয়ে আরেকবার কাঁটার খোঁচা খায় ধীমান। উফ্‌। নিজের ওপরেই বিরক্ত হয় সে।
‘‘হ্যালো?’’
‘‘স্যার, খারাপ খবর আছে।’’ ফোনের ওধারে ওসি সাঁতুড়ি থানা। ‘‘একটা মার্ডার হয়েছে।’’
কিভাবে, কোথায়, ইত্যাদি জানতে চায় ধীমান। কিছুটা নির্লিপ্ত ভাবে। মোবাইল কানে, কাঁধের ঠেসে। বাঁ হাতের আঙুল ডান হাতের বুড়ো আঙুলে সূক্ষ্ম কাঁটা খুঁজে বেড়ায়।
কিভাবে মার্ডার সেটা ক্লিয়ার নয়। যিনি মারা গেছেন তিনি একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক। মেঘদূত আচার্য। সাঁতুড়ির বরন্তির কাছে ওনার একটা ফার্ম হাউস আছে। আজ সকালে ওনাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই।
‘‘মার্ডার ভাবছেন কেন?’’ জানতে চায় ধীমান। স্বাভাবিক মৃত্যুও তো হতে পারে?
দিব্যি বাগান করে, অরগানিক খাবার খেয়ে হাসিখুশি মানুষ ছিলেন, স্যার। এই সেদিনও কথা হলো। ব্যাপারটা রহস্যজনক।
তাহলে KISS Rule ফলো করুন।
মানে, স্যার?
কিপ ইট সিম্পল, স্টুপিড। দেখতে হবে ওনার মৃত্যুতে কে লাভবান হচ্ছে।
এসডিপিওদের পি-ও (প্লেস অফ অকারেন্স) বা সীন অফ ক্রাইম ঘুরে দেখা বাঞ্ছনীয়। মাথা নীচু করে পুরো ফার্ম হাউস ঘুরে দেখে ধীমান। বডিও। শান্তভাবে শুয়ে রয়েছেন মেঘদূতবাবু। মুখে যেন এক স্মিত হাসি লেগে রয়েছে।
মৃতের হাতের চেটো সবসময় দেখে ধীমান। একজন মানুষকে চেনা যায় তাঁর হাতের চেটো দেখে। জ্যোতিষীদের হস্ত বিচার নয়, হাতে, আঙুলে লুকিয়ে থাকে মানুষের কাজ কর্মের ইতিহাস। মেঘদূতবাবুর হাতের চেটো বাগানে কোদাল-কাস্তে চালিয়ে খসখসে। আঙ্গুলের ডগাগুলোতে অনেক আঘাতের চিহ্ন। কাঁটার দাগ। নিজের চেটোর দিকে তাকায় ধীমান। ওরকম হাত করতে গেলে বহুকালের অধ্যবসায় দরকার। আর, প্রকৃতিকে ভালোবাসা। আপনমনে হেসে ওঠে সে।
মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট বানালেন থানার এক দারোগা। ধীমান দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করল। অনেক কিছুই হারিয়ে যায় সঠিক রিপোর্ট না বানালে। এরপর বডি পাঠানো হলো পুরুলিয়া সদরে। দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতালের মর্গে। পুরো জেলার একটাই মর্গ। সেখানে পোস্টমর্টেম হবে। ময়না তদন্ত। ময়না আরবি শব্দ। ‘মু’আয়িনা’ শব্দ থেকে বাংলায় অনুসন্ধান অর্থে ব্যবহৃত ‘ময়না’ শব্দের উদ্ভব। এই আরবি ‘ময়না’ শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত ‘তদন্ত’ শব্দ যুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে ‘ময়নাতদন্ত’ শব্দ। যার অর্থ, অস্বাভাবিক বা আকস্মিক মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে শবব্যবচ্ছেদ।
হত্যা, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনার। কোনো অপমৃত্যু বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় পোস্টমর্টেম বা ময়না তদন্ত করা বাধ্যতামূলক। এ ধরনের ঘটনায় প্রথমেই পুলিশ একটি সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। অর্থাৎ মৃতদেহ কী অবস্থায় পাওয়া গেছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এরপর মৃত্যু সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য ময়নাতদন্ত করতে পাঠানো হয়।
মর্গে অটোপসি সার্জেন বা ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সেই সুরতহাল প্রতিবেদন দেখে, প্রথমে মৃতদেহের বাহ্যিক অবস্থার বিশ্লেষণ করেন। সেখানে কোনও আঘাত বা ক্ষত আছে কিনা, ত্বক ও জীভের রঙ ইত্যাদি দেখে প্রথম প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এরপরে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে মস্তিষ্ক, ফুসফুস, লিভারসহ শরীরের ভেতরটা যাচাই করে দেখা হয়। ফলে শরীরের ভেতরে কোন আঘাত থাকলে, রক্তক্ষরণ বা বিষক্রিয়া থাকলে, সেটি চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন। কোথাও আঘাতের চিহ্ন থাকলে সেটি কীভাবে হয়েছে, তা ভালো করে যাচাই করা হয়। এই কাজটি করতে গিয়ে মৃতদেহের নানা অংশ কেটে দেখতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা। এ সময় শরীরের নানা প্রত্যঙ্গও সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়ে থাকে। ময়নাতদন্ত শেষে মৃতদেহ আবার সেলাই করে আগের মতো অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। অন্তত আনার চেষ্টা করা হয়।
মেঘদূতবাবু অনেকটা আগের মতোই ফিরে এলেন। এমনকি মুখের সেই স্মিত হাসিও অমলিন। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেতে সপ্তাহখানেক।
মেঘদূতবাবুর দুই ছেলে। একজন রঘুনাথপুর শহরে বালুচরী শাড়ি ব্যবসায়ী। আরেকজন কলকাতায় সরকারী কর্মচারী। দুই ছেলেই নিজের জগতে প্রতিষ্ঠিত। স্ত্রীবিয়োগের পর থেকে আজ বছর পাঁচেক তিনি ফার্ম হাউসেই থাকছিলেন। আগে বড়ছেলের সাথে নিজের বাড়ি রঘুনাথপুরেই থাকতেন। মাঝেমধ্যে এসে বাগানবাড়ির দেখাশোনা করতেন। ৭৫ বছর বয়সেও বেশ কর্মঠ ছিলেন তিনি। সোজা হাঁটতেন। সাইকেল চালাতে পারতেন মাইলের পর মাইল। ছেলেরা খুব একটা আসত না বাগানবাড়িতে। শীতের ছুটি বা পুজোর সময় অবশ্য নাতি নাতনী সহ সরগরম থাকত ফার্ম হাউস। বাকি সময় সঙ্গী বলতে বছর পঞ্চান্নের মালি সুবোধ আর বছর তিরিশের ট্রাক্টর ড্রাইভার কাম কুক কাম ম্যান ফ্রাইডে বঙ্কিম। সুবোধের বাড়ি এখান থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে। সাইকেলে করে যাওয়া আসা করে। কখনো থেকেও যায়। বঙ্কিম আদতে ঝাড়খণ্ডের ছেলে। চালচুলোহীন অবস্থায় বছর দশেক ওকে রঘুনাথপুরে ঘুরতে দেখে উদ্ধার করে মেঘদূতবাবুর বড়ছেলে। সেই ইস্তক টুকটাক কাজ করতে করতে বাড়ির একজন হয়ে উঠেছে সে।
দশ বিঘা জমির ওপর আম, লিচু, পেয়ারা আর পেপের বাগান। রয়েছে মরশুমি সব্জির চাষ। গ্রীষ্মে ভেন্ডি, শীতে ফুলকপি, বাঁধাকপি। এক মাঠ সর্ষে হয় প্রতিবছর। সেই সর্ষের তেলেই চলে আচার্য বাড়ির রান্নাবান্না। গোয়ালে খান পাঁচেক গরু। বিঘা দুয়েক বড় পুকুরে তেলাপিয়ার চাষ। মাঝরাতে গাড়ি করে মাছ যায় কলকাতায়। বাগানের মাঝে দোতলা পাকা দালান। গোটা চারেক ঘর, বড় ডাইনিং, হাল ফ্যাশনের বাথরুম। নিজের মনের মতো করে বানিয়ে তুলেছিলেন।
মেঘদূত বাবুর ঘরে মাসানোবু ফুকুওকার বই দেখেছিল ধীমান। ‘ওয়ান স্ট্র রেভুলেশন’। বইয়ের প্রচ্ছদে ওনার ছবি। বর্ষীয়ান এক পুরুষ। চোখে তাঁর বুদ্ধির দীপ্তি। ঠোঁটে আত্মবিশ্বাসের হাসি। বকের পালকের মত সাদা তাঁর চুল, দাড়ি, গোঁফ। মাথায় সামান্য টাক। জাপানি চাষী ছিলেন  তিনি। সাধারণ চাষী নন, কৃষি গবেষক। তাঁর হাতে সবসময় একটা শুকনো খড় থাকত। নিজের খেতের ধানের খড়। তিনি যখন বিদেশে যেতেন, দেশবিদেশে সভা-সেমিনারে বড় বড় লোকদের উদ্দেশে কথা বলতেন, তখনও তাঁর হাতে ওই খড়টি থাকত। সারা পৃথিবী ঘুরে তিনি বলে বেড়াতেন ওয়ান স্ট্র রেভুলেশনের কথা। অর্থাৎ একটা খড় দিয়ে তিনি বিপ্লব ঘটাবেন।

তাঁর চাষপদ্ধতি ছিল অভিনব। ধরা যাক, মাঠে একটা ফসল আছে, যেটা দু'-চারদিনের মধ্যেই কেটে গোলায় তোলা যাবে। এ-অবস্থায় ফুকুওকা নতুন ফসলের বীজ মাঠে ছিটিয়ে দিতেন। ফলে আগের ফসল কাটতে কাটতে দেখা যেত, নতুন বীজ থেকে চারা গজিয়ে গেছে। তখন তিনি ওই কাটা ফসলের খড়গুলো বিছিয়ে সমস্ত খেতটি ঢেকে দিতেন। বৃষ্টির জলে ভিজে, রোদে পুড়ে খড়গুলো সার হয়ে মাটির সাথে মিশে যেত। একই সাথে পচা খড় ভেদ করে বেরিয়ে আসত নতুন সবুজ ধানগাছ কিংবা অন্য কোন ফসলের চারা। এভাবে ফুকুওকা একটার পর একটা নতুন ফসল গোলায় তুলতেন। বছরের কোন সময়ই তাঁর খেত ফাঁকা থাকত না। তাঁর খেতের জমি দিনের পর দিন আগের থেকে উর্বর হচ্ছিল এবং ফলনও বাড়ছিল আগের বারের চেয়ে। কিন্তু বাইরে থেকে কিছুই করতে হত না তাঁকে, না হালচাষ, না সেচ, না রাসায়নিক সার বা কীটনাশক প্রয়োগ। তিনি তাঁর এই চাষপদ্ধতির চমৎকার একটা নাম দিয়েছিলেন: ডু নাথিং এগ্রিকালচার। তিনি বলেছেন, মাটির তেজ আর ফসলের স্বাস্থ্য ভাল থাকলে কীটপতঙ্গ ফসলের কোন ক্ষতি করতে পারে না। কোন আগাছাই তাঁর ফসলের শত্রু নয়। তাই তাঁর খেত সবসময় আগাছায় ভর্তি থাকত।
নাহ্‌। কোনো শ্ত্রু পাওয়া গেল না মেঘদূতবাবুর। ছেলেরাও এসে ক্লিনচিট দিয়ে গেল সুবোধ ও বঙ্কিমকে। দেহ দাহ করার সময় হাউহাউ করে কাঁদছিল সুবোধ। থম মেরে বসে ছিল বঙ্কিম।
এক সপ্তাহ পরে এলো পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। মৃত্যুর কারণ ‘এপিডেমিক ড্রপ্সি’। একধরনের বিষক্রিয়া। এই বিষক্রিয়ার লক্ষণ শরীরে জল জমে যাওয়া। অবাক হল বাড়ির লোকজন। এই বিষক্রিয়া নাকি খাদ্যের মধ্যে থেকে হয়। একটা সাত্বিক জীবনযাপন করা লোকের কি করে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়? যে কোনোদিন মদ খাননি। ঘরের খাবারের অন্যথা করেননি কোনোওদিন।
চিন্তায় পড়ে গেল ধীমান। বাগানবাড়ির রান্নাঘর, হেঁসেল খুঁজে কোনও বিষের চিহ্ন নেই। ফুকুওকার ভক্ত মানুষটির ত্রিসীমানায় কীটনাশকও ব্রাত্য। রাসায়নিক সারও নৈব নৈব চ। তাহলে?
এক প্রকার হাল ছেড়ে দেওয়ার অবস্থা। দিনকয়েক কাটল। আচার্য বাড়ির তরফেও কোনও উচ্চবাচ্য ছিল না। কেমন যেন নিস্পৃহ সবাই। অন্য মামলায় নিবিষ্ট হয়ে গেছিল ধীমান। সপ্তাহখানেক বাদে মেঘদূতবাবুর বড় ছেলেকে হঠাৎ এমনিই ফোন করে বসে সে। হালহকিকত জানার জন্য। বাগানবাড়িটা বিক্রি করে দিচ্ছি,— জানালেন তিনি।
‘‘আসলে বাবা চলে যাওয়ার পরে ওটা দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ভাই কলকাতা ছেড়ে এদিকে আসবে না। আমি আমার বালুচরী শাড়ির দোকান ছেড়ে বেরোবার ফুরসত পাই না।’’
‘‘কে কিনছেন?’’— জিজ্ঞাসা করল ধীমান।
‘‘কলকাতার এক ব্যবসায়ী। অক্ষয় লালা। জায়গাটাকে নাকি রিসোর্ট বানাবেন। আজকাল শহরের অনেকেই চাইছেন খামারবাড়ি, বাগানবাড়িতে এসে উইকএন্ড কাটিয়ে যাওয়ার। তাছাড়া জায়গাটা বরন্তির কাছেই। এমনিতেই সারাবছর ট্যুরিস্ট আসে। তাই অফারটা ফেরালাম না।’’
‘‘কলকাতার ব্যবসায়ী বললেন, যোগাযোগ কি করে হলো?’’
‘‘ওই বঙ্কিমের থ্রু দিয়ে।’’ ভ্রু কোঁচকালো ধীমান। ‘‘বঙ্কিমের সাথে কিভাবে যোগাযোগ হলো জানতে চেয়েছিলেন?’’
‘‘আজ্ঞে না, তাছাড়া উনি বললেন বঙ্কিম আর সুবোধকে ওখানেই কাজে রেখে দেবেন। বঙ্কিমকে নাকি ম্যানেজার করে দেবে। যাক গে, ছেলেটার একটা হিল্লে হলো। বাবাই বা আর কত দিতে পারতেন।’’
কোথায় যেন অঙ্কে একটা গরমিল পেল ধীমান। গাড়ি নিয়ে সটান বিকেলের দিকে চলে গেল দেবেন মাহাতো হাসপাতালে। অটপসি সার্জেন ডঃ সুতনু চৌধুরী রাজ্যে অন্যতম সেরা ময়নাতদন্তকারী। ধীমানকে দেখে একগাল হেসে বসতে বললেন। বিকেল চারটের পর উনি ফ্রি। চারটের পর আর পোস্টমর্টেম হয় না। এক প্যাকেট সিগারেট টেবিলে এগিয়ে দিল ধীমান। ডঃ চৌধুরীর একমাত্র দুর্বলতা। ওনাকে যারা জানেন, এটা নিয়ে আসেন। ফলে, চেষ্টা করলেও উনি ওনার চেইন স্মোকিং হ্যাবিট ছাড়তে পারবেন না। ফস্‌ করে দেশলাই দিয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে সুখটান মেরে ধীমানের থেকে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা টেনে নিলেন। এক নজর বুলিয়েই ফিরিয়ে দিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে ধোঁইয়ার রিং ছাড়তে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর নিজেই মৌণতা ভাঙলেন। “খুব চালাক আততায়ী হে, এসডিপিও সাহেব।’’
‘‘অ্যাঁ? গল্পে আততায়ীও আছে?’’
‘‘আলবাত আছে, নয়ত হয় এপিডেমিক ড্রপ্সি মিথ্যে বা আমার ময়নাতদন্ত ভ্রান্ত।’’ টুস্কি মেরে সিগারেটের ছাই ফেললেন ডাক্তার। ‘‘দেখুন দেখি গিয়ে বাগানবাড়ির চারপাশে শিয়ালকাঁটা গাছ দেখতে পান কিনা। আর খোঁজ নিন, খামারের সর্ষের তেল কোন ঘানিতে ভাঙ্গা হত।’’
পরদিন ওসিকে নিয়ে বাগানবাড়ি গেল ধীমান। বঙ্কিমকে বেশ উৎফুল্ল দেখালো। ফার্ম হাউস বিক্রির কথাটা আমরা জানি দেখে বেশ গদগদ হয়ে রইল। আমাদের দেখে সুবোধও এসে দাঁড়ালো। তবে তাঁকে বেশ মলিন লাগল। ঘুরতে ঘুরতে খামারের শেষ প্রান্তের দিকে গেল ওরা চারজন। কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে শিয়ালকাঁটার ঝোঁপ। বাংলার সবগাঁয়েই দেখা মেলে এদের। একটু সুযোগ পেলেই, মেঠোপথের পাশে মাথা উঁচু করে উঁকি দেয়। বড় বড় আম কাঁঠালের বাগানের ছায়াতেও এরা দিব্যি নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। প্রচণ্ড তাপ সহ্য করতে পারে। তাই শুকনো খটখটে মাটিতে বসবাস করতেও এদের জুরি নেই। আবার আর্দ্রমাটিও অপছন্দ নয়। তাই পুকুর বা ডোবার পাড়েও সাচ্ছন্দ্যে বাঁচতে পারে। কিছুদিন আগেই বেড়ার ধারের শিয়ালকাঁটার ঝোপ কাটা হয়েছে দেখে বোঝা গেল।
‘‘এগুলো কে কাটল?’’ প্রশ্ন করল ধীমান। সুবোধ মালি কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাঁকে থামিয়ে বঙ্কিম বলে উঠল।
‘‘ও বড় বাজে গাছ স্যার। জঙ্গল হয়ে যায়। কেটে ফেলে দিয়েছি।’’
‘‘কোথায় ফেলেছ?’’ কঠিনভাবে তাকায় ধীমান! আমতা আমতা করতে থাকে বঙ্কিম।
‘‘আজ্ঞে, ট্রাক্টরে চাপিয়ে দূরে ফেলে এসেছি।’’
আর বিশেষ ঘাঁটালো না ধীমান। বাগানবাড়ির দাওয়ায় তাকিয়াতে বসে চা অর্ডার করে। বঙ্কিম রান্নাঘরে যায়। সুবোধ উসখুস করছিল কিছু বলার জন্য। সেটা শুনতেই ধীমানের এই কৌশল।
‘‘স্যার, বঙ্কিম মাঝে মাঝেই শিয়ালকাঁটার ঝোপ কেটে ট্রাকটরে চাপিয়ে নিয়ে যায় তেল ভাঙানোর দিন।’’
‘‘তেল ভাঙায় কোথায়?’’
‘‘আজ্ঞে শালতোড়ায় একটা ঘানি আছে। মহেশ্বর মাজির। সেখানে।’’
চা খেয়ে রওনা দেয় ধীমানরা। সাঁতুড়ি থানায় গিয়ে একটা টিম পাঠিয়ে দেয় মহেশ্বরকে আনার জন্য। ঘানির মালিক স্বীকার করে যে তেলে ভেজাল না মেশালে লস্‌। শিয়ালকাঁটা মৌসুমি উদ্ভিদ। ফুল হয় হলুদ রঙের। প্রতিটা বোঁটায় একটা করে ফুল থাকে। প্রতিটা ফুলের ছটা করে পাঁপড়ি। সাধারণত ফাল্গুন মাসে ফুল ফোটে। ফল সাধারণত এক ইঞ্চি লম্বা হয়। অনেকটা তিলের ফলের মতো দেখতে। ভেতর ৪০-৫০টা বীজ থাকে। চৈত্র মাসের শেষ থেকে বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বীজ পাকতে শুরু করে। শিয়ালকাঁটার বীজ দেখতে অনেকটা সর্ষের মতো এবং সেই বীজের তেল দেখতে অনেকটা সর্ষের তেলের মতো, তাই সর্ষের মধ্যে এর ভেজাল ব্যবহার হয়। তবে ভোজ্যতেলে শিয়ালকাঁটার তেলের ভেজালের মাত্রা ১% এর বেশি হলে বিষক্রিয়া দেখা যেতে পারে। যার ফল হয় মারাত্মক। বঙ্কিমকে ধরে আনার নির্দেশ দিল ধীমান। কিছুক্ষনের মধ্যেই হুকুম তামিল। মহেশ্বরকে সামনা সামনি বসিয়ে জেরা করা হলো। ভেঙ্গে পড়ল সে। অক্ষয় লালার অফারটা লুফে নিয়েছিল বঙ্কিম। উপায়টাও বাতলেছিল সে।
শিয়ালকাঁটার তেলের মধ্যে দুটি বিষাক্ত উপক্ষার। স্যাঙ্গুইনারিন ও ডাইহাইড্রোস্যাঙ্গুইনারিন। স্যাঙ্গুইনারিন অনেকটা ডিজিটালিসের মতো কোষপর্দায় অবস্থিত সোডিয়াম-পটাসিয়াম-এটিপিএজ পাম্পকে বন্ধ করে দেয়। এই ক্রিয়া স্বল্প মাত্রায় হলে কোষে ক্যালসিয়াম বেড়ে যায় ফলে হৃদযন্ত্রের সংকোচন বেড়ে এটি ডিজিটালিসের মত ড্রপ্সির ওষুধ হিসাবে কাজ করতে পারে। এই জন্যে এই গাছটির ওষধি গাছ হিসাবে ব্যবহার ছিল। কিন্তু এর মাত্রা বেশি হলে রক্তবাহের দেওয়ালের ছিদ্রগুলি বড় হয়ে রক্তরস বেশি পরিমাণে আন্তঃকোষীয় স্থানে বের হয়ে যায় ও এটি নিজেই ড্রপ্সির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলত মৃত্যু।
মহেশ্বর বেশ কিছুদিন যাবৎ শিয়ালকাঁটার বীজ মেশাচ্ছিল অল্প অল্প পরিমানে। ক্রমে পরিমান বাড়িয়ে দেয় সে। হাতজোড় করে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মহেশ্বর।
‘‘হুজুর, বাড়ির তেলে কখনও ভেজাল মেশাই না। বঙ্কিম জোর করল বলে। ভুল হয়ে গেছে হুজুর।’’
ডঃ চৌধুরীকে থ্যাঙ্কস জানানোর জন্য ফোন করে ধীমান। ওপারে নিজেকে অভ্রান্ত প্রমান করায় গলায় খুশির আমেজ।
“একটা তথ্য দিই এসডিপিও সাহেব। ১৯৭৭ সালে কলকাতায় একবার এর বিষক্রিয়ার প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। আর, ১৯৯৮ সালে উত্তর ভারতে দিল্লীর আশেপাশে প্রায় আড়াই হাজার লোকের মধ্যে খাদ্যতেলের মধ্যে ভেজালের কারণে একবার এই বিষক্রিয়া দেখা দেয় এবং অন্তত ৬৫ জন মারা যায়।’’

Post a Comment

11 Comments

  1. বেশ লাগলো। ১৯৭৭/৭৮ সালে শিয়ালকাঁটা মেশানো সর্ষের তেল খেয়ে আমাদের গ্রামের বেশ কিছু লোক পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। তার পর বহুদিন আমরা সর্ষে পিষিয়ে তেল খেতাম। লেখাটা পড়ে সেই কথা মনে পড়ে গেল।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ দাদা

    ReplyDelete
  3. খুব সুন্দর

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো হয়েছে ।

    ReplyDelete
  5. অসাধারণ লিখেছেন স্যার

    ReplyDelete
  6. অসাধারণ লিখেছেন স্যার

    ReplyDelete
  7. বেশ লাগল। ঝরঝরে লেখা। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম। কলম চলুক পুলিসবাবু। 🙂

    ReplyDelete
  8. পড়লাম।লকডাউন পরিস্থিতিতে মনে যখন শুধুই অতৃপ্তি, তখন এমন গল্প একটা অন্য স্বাদ এনে দিল।

    ReplyDelete
  9. লেখাটি দ্যুতি র মান দুটিই অতি উত্তম

    ReplyDelete
  10. দারুন লেখা sir

    ReplyDelete
  11. খুব সুন্দর লেখা। নির্মেদ, টানটান।নিমেষে পড়া হয়ে যায় আর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কৌতূহল জাগিয়ে রাখে।আর কতকিছু যে জানি প্রতিবার আপনার লেখা পড়ে! ভালো থাকুন, আরও লিখুন...অপেক্ষায়॥

    ReplyDelete