লকডাউনের দিনলিপি

আগামী ও আগামীকাল

তিতাস বন্দ্যোপাধ্যায়


আমি কি বেঁচে আছি?
জানালার দিকে এগিয়ে যাই। কড়া রোদ  ঝলসে দিচ্ছে আকাশ। উল্টোদিকের বাড়ির দেওয়ালে একটা মাছরাঙা বসে আছে। আশেপাশে তো কোনও পুকুর নেই! কে জানে কেন এসেছে এখানে! মাছরাঙাটার শরীরের একটা অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য রোদের কড়া শাসনকে হারিয়ে আমার চোখে বেশি করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চিৎকার করে বলতে গেলাম— ‘হুস! যা, যা! এখানে মাছ পাবি না’— কিন্তু বলতে পারলাম না। গলা বুজে এলো। 
বুঝলাম গলা এখন কাজ করবে না কারণ মাথার ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছেন জীবনানন্দ। কয়েকদিন আগে লাবণ্য দাশের ‘মানুষ জীবনানন্দ’ পড়ে জানতে পেরেছিলাম, স্ত্রী’র কর্মক্ষেত্রে ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার সুবিধার জন্য জীবনানন্দ নিজে হাতে পেন্সিল কেটে রাখতেন।
আজ স্পষ্ট দেখলাম উনি টেবিলের এককোণে বসে জীবনকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন! জীবনের আকারটা ঠিক পেন্সিলের মতোই!
‘‘মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি...।’’
হঠাৎ দোতলার রান্নাঘরে বাসন পড়ার আওয়াজ পাই! মায়ের রান্না এখনও শেষ হয়নি তবে! শুনতে পাই, বাবা মা’কে বলছেন— ‘‘ওরা ষোলোজন মারা গেলো! রেললাইনের উপর শুয়েছিল। ওদের মৃতদেহগুলো ...।’’
কানের ভেতর বোঁ বোঁ করে একটা ভীমরুল ঘুরতে শুরু করে। মাথা ঝাঁকিয়ে তাড়াতে চাই ওকে। এদিক, ওদিক, সেদিক-যাচ্ছে না! কিছুতেই যাচ্ছে না! এখন উপায়?
উপায় বেশি নেই! পাত্তা দেবো না।
বইয়ের তাকের দিকে এগিয়ে যাই। রূপকথার বইগুলো খুঁজতে থাকি। ওই যে গল্পটা, মেয়েটার সৎমা কিছুতেই মেয়েটাকে রাজবাড়ির উৎসবে যেতে দেবে না! চালে কাঁকর বাছতে দেবে! তারপরও কীভাবে যেন ইঁদুরেরা হয়ে যাবে ঘোড়া। ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চেপে মেয়েটা রাজবাড়ির উৎসবে যাবে... ইঁদুরদের ঘোড়া বানানোর উপায়টা জানা দরকার। এতদিন মানুষদের খাবারে ভাগ বসিয়েছে তারা। ভাঁড়ার থেকে টেনে নিয়ে গেছে খাদ্যদ্রব্য এখন তো তাদের ঘোড়া হতেই হবে। 
বুকের মধ্যে লক্ষ লক্ষ পায়েদের মিছিল শুরু হয়।
আবার সেই এক প্রশ্ন, বেঁচে আছি? ভাবনা শুরু হতেই এবারও জানালার দিকে চোখ চলে যায়। রোদ কখন যেন প্রথম চুম্বনের পর কিশোরীর গালের মতো কোমল হয়ে গেছে! কয়েকটা কুকুর দৌড়াদৌড়ি করছে রাস্তায়। ম্যারাথনের প্রস্তুতি বোধহয়!
হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে আসছে, ‘‘সারাদিনের খবর নিয়ে আমি তমালিকা আপনাদের সঙ্গে আছি। সারা দেশে আজ করোনা আক্রান্তের সংখ্যা চল্লিশ হাজার ছাড়ালো। মৃত দুহাজারেরও বেশি! লকডাউন ওঠার কোনো সম্ভাবনাই এখন নেই।’’   
লকডাউনের আরেকটা দিন কেটে গেলো?
তাহলে বোধহয় বেঁচেই আছি। 
আগামীকালও বেঁচেই থাকবো, কী বলেন? 

Post a Comment

1 Comments