বিশেষ নিবন্ধ

হাসপাতাল শুনে পালালেন মাসিমা

নাসরিন নাজমা


এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম, কেউ ফ্ল্যাটে থাকা নিয়ে আপত্তি জানায়নি!
ফ্ল্যাটে ঢোকার পরই কোলাপসিবল, দরজার নব সমস্ত কিছু স্যানিটাইজার দিয়ে স্নান করে দু’খানা ব্যাগ নিয়ে সোজা ঢুকে পড়লাম বাথরুমে। রীতিমতো এক মহাযুদ্ধ শুরু হল। শুধুমাত্র মোবাইল ফোন, চার্জার, হেডফোন আর পার্স বাদে আর যা কিছু মানে জামাকাপড় থেকে জুতো, কসমেটিক্স থেকে মেডিসিন, কেক থেকে পেন-পেন্সিল সমস্তটাই সাবানজলে কেচে ধুয়ে তবে শান্তি। কেউ OCDর patient ভাবতেই পারেন, তবে এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। এরপর স্নান সেরে শুদ্ধ হয়ে বেশ কদিনের বিরহ অপেক্ষায় থাকা নিজের বিছানায় পৌঁছলাম। কাছের মানুষদের ফোনগুলো চটপট সেরে নিতে হবে এবার। নিরাপদে বাড়ি পৌঁছনোর খবরটা তাদের জানিয়ে দিয়ে একটু বিশ্রাম দরকার।
এই ফ্ল্যাটে আমি একাই থাকি। রাতের খাবার নিজেই তৈরি করে, খেয়ে নিয়ে সেদিনের মতো শুয়ে পড়লাম। রাত নির্বিঘ্নে কাটলেও, সকালে যে অপেক্ষা করে আছে চমক তা ভাবতেও পারিনি। যেদিন অফিসে যাওয়ার থাকে না সেইগুলোয় সাধারনত দেরি করেই বিছানা ছাড়ি, কারণ আমি ‘late to bed, late to rise’ এর দলে। এখন home isolation এর কটা দিন সকালে ওঠার চিন্তা সেরকম নেই তবে পৌরসভার জঞ্জালের ভ্যাট যেহেতু সকালেই আসে তাই উঠতে হবে। এককালে রাধা কৃষ্ণের বাঁশির অপেক্ষায় থাকতো আর এখন আমরা ব্রতদার বাঁশির আওয়াজের জন্য অধীর প্রতীক্ষা করি। যাইহোক, সকালে দরজাটা সবে খুলেছি, কোলাপসিবল তখনও তালাবন্ধ, দেখি আমার উপরের দুই ফ্ল্যাটের দুই মাসিমা (একজন সিঁড়ির মাথায়, আরেকজন লিফ্ট এর ভেতর) গল্প করছেন। আমি চোখ কচলাতে কচলাতেই জিজ্ঞেস করলাম ঠেলাগাড়ি নিয়ে যে সব্জিওয়ালা দাদা আসে সে চলে গেছে কিনা। আমার সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক মাসিমা জিজ্ঞেস করলেন ‘তুমি কি এই কয়েকদিন হাসপাতালে ছিলে? আমি তার উত্তরে হ্যাঁ বলতেই, রীতিমতো ভূত দেখার মত আতঁকে উঠলেন দুজনেই। তারপর ‘ও বাবা রে, হাসপাতাল থেকে এসেছে, চলো পালাই পালাই’, বলে দুজনেই এমন রুদ্ধশ্বাস দৌড়লেন যে সব্জিদাদার খোঁজ আর পেলাম না। হতভম্বের মতো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বেরোলাম বাজারের দিকে।
বাজার বাড়ির খুব কাছেই। গোটা সময়টাই ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে। আবার কেউ কিছু বলবে নাতো! খুব তাড়াতাড়ি কিছু সব্জি, ফল, মাছ কিনে বাড়িতে ফিরে সেই যে দোর দিয়েছি, আর খুব প্রয়োজন ছাড়া খুলছি না। মাঝে মাঝেই ভাবতে বসলে খুব অবাক হচ্ছি। যে মাসিমার সঙ্গে কথোপকথন হয়েছিল সকালে, তার বাড়িতে নাতনিকে টিউশন পড়ানোর টিচার এখনো নিয়মিত আসছেন, সপ্তাহে নিয়ম করে গানের টিচার তালিম দিয়ে যাচ্ছেন, কাজের দিদি ঘরমোছা বাসন মাজার কাজ করতে আসছে। এর অন্যথা হয়নি। তাহলে ওদের মাধ্যমে কি করোনা ছড়াতে পারে এটা উনি জানেন না নাকি ওদের করোনা আক্রান্ত হওয়া অসম্ভব (কারণ তারা হাসপাতালে যায়নি) এটাই উনি মনে করেন! নাকি মাস শেষে মাইনেটা যখন দিতেই হবে তখন শুধু শুধু ওদের ছুটি না দিয়ে কাজটা উসুল করেই নিচ্ছেন। একটা রাগ, মন খারাপ গলার কাছটায় তেতো হয়ে আটকে রইলো। যাদের জন্য এতগুলো মানুষ দিনের পর পর দিন নিজের কাছের মানুষদের থেকে দূরে থাকছে, ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কাজ করছে নিজেদের ভবিষৎ না ভেবেই সেই আমরাই চুরি করে ধরা পড়ে যাওয়ার পরের অবস্থার মতো বন্ধ দরজার আড়ালে চুপি চুপি কাটাচ্ছি home isolation এর একলা দিন।
হঠাৎ করেই ভীষন মন খারাপটা আবার চেপে বসলো মনে, মাথায়। এই কদিন ভীষন ব্যস্ততায় কেটে গেছে, কিন্তু isolation এর কদিন কী করে কাটবে একা একা সেটা ভেবেই অস্থির হচ্ছি। খুব মনে পড়ছে মোনাই আর তনুশ্রীকে। আমার সবচেয়ে আপনজনদের মধ্যে ওরা দুই শয়তান যাদের সঙ্গে জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্ত share না করলে কোনও কিছুই পরিপূর্নতা পায় না। প্রত্যেক শনিবার আবৃত্তির রিহার্সাল সেরে ফেরা হতো আমার বাড়িতে। তারপর সারারাত কাটতো আড্ডায়, গল্পে। কতদিন হয়ে গেল ওদের সঙ্গে দেখা হয়নি, খুব মিস করছি ওদের। পেটের মধ্যে সমস্ত কথা যেন বুজকুড়ি কাটছে অস্থির হয়ে। কবিতাবাড়ির ক্লাস, রিহার্সাল, আড্ডা, সবার সঙ্গে খুনসুটি, গানের কথা ক্লাস সবকিছু কবে আবার ফিরে পাব, কবে আবার হাসি, গল্প, গানে মেতে উঠবো ঠিক আগেরই মতো সেইদিনের অপেক্ষায় আছি।



Post a Comment

0 Comments