স্তব্ধ দিন উৎকণ্ঠায় বিলীন
শ্রেয়ম কর
২০২০ এক নতুন দশকের সূচনা। ক্ষেত্র বিশেষে বক্তার একটি সংক্ষিপ্ত সূচনা যথেষ্ট সমীচিন হয়ে ওঠে। সুতরাং এই লকডাউনের দিনলিপির প্রাক্কালে; আমি স্বয়ং বক্তা, পরিচয় বঙ্গ সন্তান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম বাংলা তাদের সন্তানদের গৌরবে গৌরবান্বিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু সরাসরি যোগে নয়, শিকড়ের টানে। অর্থাৎ বাঙালি এগিয়ে কিন্তু বাংলা কর্মসংস্থানে, রুজিরুটির চাহিদা পূরণে বহুলাংশে পিছিয়ে। তাই আজ আমরা অনেকেই প্রবাসী বাঙালি।
গত ন’মাস হল আসামের শোণিতপুর জেলার বাসিন্দা হয়ে দিন গুজরান করছি। বছর ঘুরতেই ফেব্রুয়ারির শেষে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল COVID-19 মহামারী। দেখতে দেখতে ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করে ফেললো। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এবং প্রাণ ভয়ে আজ প্রায় পঞ্চাশ দিন লকডাউনের পরিস্থিতি অব্যাহত। ধীর পায়ে গল্পে মশগুল প্রৌঢ়দের সঙ্গে না পেয়ে দীর্ঘদিন একাই হেঁটে চলেছে ভোরের রাস্তা। ঘুম ভেঙ্গে উঠে কিশলয়গুলো বাড়ির জানালা দিয়ে চেয়ে থাকে বাইরে। উৎকণ্ঠা মিশ্রিত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবে আবার কবে দেখতে পাবে তাদের পাশে বসা বন্ধুদের! কবে হর্ন বাজাবে স্কুলের গাড়ি! নিষ্পাপ চোখগুলো বুঝিয়ে দেয় তারাও অনেকটাই সমঝদার হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। লকডাউনের প্রথম সপ্তাহটা কোনওরকমে কাটিয়ে দিলেও দ্বিতীয় তৃতীয় সপ্তাহ জুড়ে বাড়ির বড়দের কাছে যে বায়না করতো তা এখন আর তারা করে না। ‘ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন’—- এই সাবধানতার বার্তা শুনে শুনে তারাও অভ্যাসের বসবর্তী হয়ে উঠেছে। রাস্তার পাশের রুটি পরোটার দোকানে ভিড় জমায় না সাইকেল চড়ে দল বেঁধে আসা দিনমজুর ভাইয়েরা-দাদারা। আর মুখোমুখিও হতে হয় না রোজকার অভ্যেস বসত মানুষের মনের অন্তঃস্হলে ফুটন্ত রক্তে ভেসে থাকা রকমারি জিলিপির প্যাঁচের সাথে। প্রতিদিন মুখে হাত টুকু তুলতে পারার মত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, খাদ্য সামগ্রীর পসার সাজিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আছে দীনদয়াল স্টোর্সের মতো গুটি কতক দোকান। অফিস কাছারি ও অন্যান্য দপ্তরে নিশ্চয় এতদিনে কাগজপত্র টেবিলের ওপর পরতে পরতে জমেছে ধুলোর আস্তরণ। তবে আক্ষেপ একটাই - ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্হসেবী কর্মীদের এই অক্লান্ত পরিশ্রমের কাহিনীও বিক্রি হয়ে যাবে খবর কাগজের মতো দশ টাকা কেজি দরে। আবার নিকট ভবিষ্যতে কোনও দিন, এতটুকু স্বার্থে আঘাত লাগলেই পড়ে পড়ে মার খাবে আজকের ওই রিয়েল হিরোসদের কেউ কেউ। হ্যাঁ মশাই, ঠিকই ভাবছেন স্বার্থের খেলা যে বড়ই নিষ্ঠুর।
এলাকাটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি নামকরা সংস্থার সংলগ্ন। সুতরাং, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার আচ্ছাদনে সর্বদা সুরক্ষিত, এমনকি স্হানীয় খুচরো হাতটানের দৃষ্টান্ত একটি বিরল ঘটনা প্রায়। সুদূর প্রসারিত দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত জমি, পুকুর, ডোবা, বাঁশ বাগান, বট, অশ্বথ আরও রয়েছে অনেক সবুজের সম্ভার। জনবসতি যথেষ্টই কম। শাসকের বন্দুক উঁচিয়ে না কে হ্যাঁ করার মতোই জোর করে শহরতলি আখ্যা দেওয়ার জন্য শুধু রয়েছে গ্রামের বুক চিরে চলে যাওয়া পিচের রাস্তা আর ইতিউতি উঁকি দিয়ে জেগে ওঠা দ্বিতল ত্রিতল বিশিষ্ট পাকা বাড়ি। তথাপি আধুনিকিকরণের ছোঁয়া চোখে পড়ে বেশ। দূরত্বের সাপেক্ষে যথাক্রমে তিন এবং পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে একটি জনসাধারণের এবং সদা ব্যস্ত একটি সেনাবাহিনীর বিমান বন্দর। প্রকৃতির খুব কাছে এমনি মনোরম পরিবেশে একটি বাড়ির তৃতীয় তলে আমার সাধের একখানি কামরা, খুব ছোট বললে ঘরটির লৌহ নির্মিত হৃদয়েও সজোরে আঘাত হানা হবে বই কি! উত্তর পশ্চিম মুখী কাঁচের জানালা গুলো আমার ঘর বন্দি দশার অন্যতম আকর্ষণ।
ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী, ভারতের উত্তর পূর্বের প্রায় সীমান্তবর্তী হওয়ায় সূর্যের প্রথম উপহার এসে পৌঁছায় এই স্হানে। গ্রীষ্মের দিনে ভোর হয় যখন হাত ঘড়ির কাটা তখন সাড়ে চারটে ছুঁই ছুঁই। ঘুম ভাঙ্গে কত নাম না জানা হরবোলা পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে। ঘণ্টা খানেক পরে যখন পাখিদের কলতান কিছুটা কমে, ওদিকে দরজার বাইরে ব্যালকনি পেরিয়ে নারকেল গাছের আড়ালে আবডালে পুব আকাশের রাঙা সূর্যের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমার দিনের শুরু।
কোনওদিন যদি একটু বেশিই ঘুমিয়ে পড়ি, আমার উত্তরের জানালায় দুই অতিথি উড়ে এসে তাদের চঞ্চুর অগ্রভাগ দিয়ে ক্রমাগত জানালায় আঘাত করে হয়তো এটাই বোঝাতে চায় -‘উঠে পড়ো, ভোরের এই অমূল্য সময়টা এভাবে ঘুমিয়ে কাটিয়ো না।’ সেই মতো উঠে পড়ে তাদের দেখতে দেখতে মনে হয় হঠাৎ যেন কত বড় হয়ে গেলাম, তাই আর সেভাবে ঘরে থাকার সুযোগ মেলে না বহু বছর, আর আগের মতো মায়ের স্নেহের ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙ্গে না। অতিথি দু’জনের খুনসুটি দেখতে থাকি আর ওদের কথাবার্তার একনিষ্ঠ শ্রোতা হয়ে কি যেন ভেবে চলি আপনমনে। খানিক পরে চলে যাওয়ার আগে কলকল করে হয়তো এটাই বলে— ‘তাহলে আজ আসি, আবার কাল ঠিক এই সময়ে দেখা হবে বন্ধু!’ তাদেরকে অস্ফুট বিদায় জানিয়ে তালিকার পরবর্তী অন্তর্ভুক্তিতে আসে উত্তরের রাস্তা পেরিয়ে কোল ঘেঁষা মস্ত পুকুর এবং পুকুরের পাড়। চারিপাশের গাছ গাছালিরা আঁকার খাতায় তুলিতে রং ছড়িয়ে দেওয়ার মতো সবুজের প্রতিফলনে বর্ণহীন স্বচ্ছ জলকে জীবন্ত করে তোলে। আনাচে কানাচে সুনীল আকাশের তলে নীলিমায় নীল হয়ে প্রেক্ষাপট পরিপূর্ণতা পায়। হাওয়ার সাথে জলকেলি দেখে ঠিক যেন মনে হয়, দুয়ে মিলে কোনো বহু জনপ্রিয় মৃদু ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে এক দৃষ্টি মধুর অঙ্গ ভঙ্গিতে নিবিড় হয়ে আছে। পূর্ব পাড়ের দুটি গাছ এমন অদ্ভুত রকম যেন বিদেশি কোনও নাচের ভঙ্গিতে একে অপরকে আলিঙ্গন করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কয়েক দশক ধরে, হয়তো করেছে শতাব্দী পার।
বেলা বাড়তে থাকলে, এক এক করে নিজস্ব কাজ কর্ম, বই পড়া, লেখালিখি শেষ করা। একঘেয়েমি কাটাতে চলভাসের সাথে আন্তরিক যোগাযোগ মানুষের বহু আগেই ঘটে গেছে। মাঝে মধ্যে গগন ভেদি শব্দে নামতে থাকে সৈনিক বিমান। সেই উত্তরের জানালা তেই দৃশ্যমান তাদের অবতরণ পথ। সৌভাগ্যক্রমে উত্তরণ পথ অন্যত্র হওয়ায় নিজের অজান্তেই শ্রবণ যন্ত্রটি নির্মাতাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়। খাদ্য সংস্থানের জন্য কষ্ট করা বলতে পাশে রাঁধুনীর বাড়ি থেকে থলিতে করে নিয়ে আসা মাত্র। তারপর স্বল্প দিবানিদ্রা কিংবা কোনো চলচ্চিত্র আমার নিঃসঙ্গ দুপুরের সম্বল। দুপুর পেরিয়ে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে। পশ্চিমের আকাশ বরাবর দূরে ভূটানের সুউচ্চ পাহাড়ের ওপারে সূর্যাস্ত হয়। সূর্যাস্তের শেষ আভা টুকু পড়ে থাকে উত্তরের অরুণাচল প্রদেশের পাহাড়ের উপর পেঁজা তুলোর মতো ইতস্তত ভেসে বেড়ানো একদল মেঘের কোলে। পুকুরের মাছ ধরা সাঙ্গ করে বক সঙ্গীরা ফিরে যায় নিরাপদ আশ্রয়ে। ক্রমে সন্ধ্যা নামে। রাতের ঘন অন্ধকার জনমানবের প্রতি যেন এরকমই এক নির্মম পরিহাস ব্যক্ত করে-
‘চেয়ে দেখ হে মানবজাতি, অবশেষে এই তোমার পরিণতি-
চারিদিকে তোমার মুক্ত বাতাস, তবু মুখে যে তোমার জীবনের ত্রাস।’
24 Comments
😊😊
ReplyDeleteCongrats...Chaliye jao👍
ReplyDeleteKhub Bhalo...😇👌
ReplyDeleteBahh darun Carry on 👍👍
ReplyDeleteOsadharon lekha vai 😊😊
ReplyDeleteBahhhh.... Egiye cholo evabei.. ❤
ReplyDeleteKhub sundor ....
ReplyDelete👌👌 #kar
ReplyDeleteদারুন হয়েছে শ্রেয়ম দা ❤️
ReplyDelete#কবি
Deletebahh..khub valo likhechis vae...🌼
ReplyDeleteKhub sundor
ReplyDeleteOsadharon sir...
ReplyDeleteOsadharon sir!
ReplyDeleteValo likhechis and its true...😊, Hope we all get bounce back soon.
ReplyDeleteValo hoye6e😍😍😍😘😘😘
ReplyDeleteKhub sundor🌷
ReplyDeleteKhub bhalo hoyeche 👍
ReplyDeleteAwesome....khub valo hoe6e 👍👍👍 keep it up...🔥
ReplyDeleteExcellent vai ���� keep it up
ReplyDeleteShreyam sera👌
ReplyDeleteদারুণ লাগলো দাদা..
ReplyDeleteখুব ভালো হয়েছে
ReplyDeleteKhub bhalo likhecho❤️Aro erokom lekhar ashaye thaklam
ReplyDelete