লকডাউনের দিনলিপি

নতুন পৃথিবীর স্বরলিপি            

দেবাশিস চন্দ


ঘরকুনো লোকের আবার বন্দিদশা কী! সেই ছোটবেলা থেকেই বাড়ির বাইরে যেতে, হুল্লোড় করতে যার খুব একটা নেই আগ্রহ তার অন্তরিন সময়ের দিনলিপিতে আবেগের জোলাপ, চোখের জল থাকবে না বলাই বাহুল্য। বিকেলবেলা বন্ধুরা যখন ডাকত ফুটবল নিয়ে বা শীতের সময় ক্রিকেট খেলার জন্য তখন সেই স্কুলবালক যখের ধন বা টেনিদা বা ফেলুদায় গেছে হারিয়ে। ঠাকুমা তাড়া দিচ্ছে— যা যা একটু খোলাধূলা কইরা আয়। বন্ধুরা ডাকতাছে। শরীর–সাইস্থ ভাল রাইখতে গেলে একটু খেলাধূলা দরকার। অনেক ঠেলাঠুলির পর বালক মাঠের সবুজ ঘাসে ফেলে পা।
এখন সূর্যাস্তের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বাইরে বেরোতে হবে ভাবলেই আসে কাঁপুনি। এমনিতেই যে জীবিকায় অন্নসংস্থান তাতে আজ এই ছুটি তো কাল ওই ছুটি— যা সরকারি বাবু, শিক্ষক বা অন্য অনেকে পেয়ে থাকেন তার বালাই নেই। সাপ্তাহিক ছুটি আর গোণাগুনতি দিন কয়েকের ছুটিতে ঘরে বসেই বিশ্বদর্শন বা আত্মদর্শন। বই, গান, সিনেমা, দূরাভাসে, আন্তর্জালে। তাছাড়া শিল্পকলা সংগ্রহ বা লোকশিল্পীদের তৈরি অশ্ববাহিনীকে সচল রাখতে খানিকটা তোষামোদ। এবং ক্লান্তিও করে না ক্ষমা। যতই তাকে প্রভু বলে ডাকি না কেন। ফলে মাঝে মধ্যে ক্লান্তিও উপড়ে ফেলে। ঢলে পড়ি। ঢলে পড়তে বাধ্য হই।         
তবে এ তো স্বেচ্ছা আরোপিত অন্তরিন বা অবরুদ্ধ আলপনা। বিলাস বাসনা। এখানে নিজেই নিজের পরিচালক, প্রযোজক। কিন্তু পরিচালনা, প্রযোজনার ব্যাটন যদি চলে যায় অন্য কারোর হাতে? যাকে যায় না দেখা, যাকে যায় না অনুভব করা, যার নেই কোনও রংরসগন্ধশ্বাসপ্রশ্বাস, যার ভয়ে থাকতে হয় কুঁকড়ে? তখন অস্বস্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এক অদ্ভুত অস্থিরতা টেনে নেয় অন্ধকার আরও অন্ধকারে। করোনা–কারণে যা হল আর কী। ব্যাটন আর নেই নিজের হাতে। লকডাউনের আরোপিত অন্তরিনে ঘরবন্দি। স্ব–অধীন আর নই। নিজের ইচ্ছা–অনিচ্ছা ভেসে গেছে ভাইরাস–ভেলায়। অন্যের ইচ্ছার দাস এখন। সেই ‘অন্য’–র আবার বহুরূপীর মতো হাজারো রূপ। কে কখন কী বলবে, কে কখন কীভাবে শানাবে আক্রমণ বোঝা দায়। অজানা আক্রমণের ভয়ে কুঁকড়ে থাকা দিন–রাত। এখন নতুন সকাল বলে কিছু নেই। ভোরের সূর্য কোনও নতুন খবর নিয়ে আসে না। সন্ধ্যাগুলো কবিতায় ছবিতে গানে গল্পে হাসিতে জলতরঙ্গের মতো বেজে ওঠে না। বন্ধুরা মাতে না তরজায়। ভালবাসা ধরে না জড়িয়ে। মিলিয়ে গেছে প্রেমিকার উচ্ছ্বল হাসি।       
বন্ধ দরজায় মাথা ঠুকে যাচ্ছি। পৃথিবীর চাকা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই অচলায়তনের সামনে প্রথম দু’সপ্তাহ দিশেহারা, নির্বাক। জানালা দিয়ে শুধু দেখে যাওয়া সন্ন্যাসীর মতো নির্লিপ্ত আকাশ। বিশালাকার এক দৈত্য যেন চেপে ধরেছে গলা থেকে হৃদপিণ্ড। প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রমণ।
কোথায় আলো ওরে কোথায় আলো!
কিন্তু এই আক্রমণের সামনে মাথা নত করলে তো চলবে না। সমর্পণও নয় কাম্য।
অতএব ঘুরে দাঁড়ানো। ধীরে ধীরে। অন্ধকারেই। রাজপথ না পেলে আলপথ। অস্বস্তির কাঁটাতার অনেকটাই পেরনো গেল। জীবনে কত বিপর্যয়ই এসেছে। সেসব যদি কাটানো যায় তবে নয় কেন অবরুদ্ধ অভিশাপ!
আশা আর স্বপ্নে ভর করে নতুন পৃথিবীর দিকে যাত্রা। আরোপিত বন্দিশালাকে রূপান্তরিত করে তোলা নিজস্ব সৃজন–সৈকতে। যে সৈকতের রূপসাগরে ডুব দিলে উঠে আসছে অরূপরতন। রাশি রাশি ভারা ভারা। প্রাথমিক ভয়, জড়তার গহ্বর পেরিয়ে এই সৃজন–সৈকতে দাঁড়িয়ে রোজ সকাল থেকে গভীর রাত অবধি ভেসে যাওয়া কবিতা, গান, সিনেমা, গল্প, শিল্পকলার নিত্য নতুন সমীরণে। কত নতুন কবির সঙ্গে দেখা রোজ। কত গায়কের গানে ভেসে যাচ্ছে অবরুদ্ধ ঘর। গুণীজনদের বক্তব্য, চিকিৎসক, চিকিৎসা কর্মীদের কাজ জোগাচ্ছে সাহস। বন্ধু–কন্যা শিঞ্জিনী ঘোষের কতই বা বয়স। শ্রীরামপুরহাট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিক্ষক–চিকিৎসক শিঞ্জিনী যেভাবে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় এগিয়ে গেছে তা ভাবলেই মনের কোণে জমা কালো মেঘ যায় সরে। এই তো সেদিন দেখলাম গৃহবন্দি যোগেন চৌধুরী তাঁর ছটি অঙ্কণে ভয়ঙ্কর সময়কে ধরেছেন। বললেনও সুন্দর। না, নেই কোনও হতাশা। সবটাই আশার আলোয় আলোকিত। প্রিয় কবি, প্রিয় মানুষ বিভাস (রায়চৌধুরী) তো অন্তরিনের শুরু থেকেই শুনিয়ে যাচ্ছে অফুরন্ত বাংলা কবিতা। কলকাতার ভদ্রাসনের বাইরে অনাদরে পড়ে থাকা কবি ও কবিতা প্রাণ পাচ্ছে তাঁর অনবদ্য পাঠে। বিভাসের প্রদীপ থেকে কত কবি জ্বালিয়েছেন তাঁদের কবিতা–নৌকোর আলো। মেঘের গুরুগম্ভীর ডাকের মধ্যে অপরাহ্নের আলোয় যখন এই লেখা লিখছি তখনই কবি, অনুবাদক সোনালী (চক্রবর্তী)  পাঠিয়ে দিল ইরফান খানের একগুচ্ছ ছবি, যার অধিকাংশই অদেখা। কবিতা পাঠের পাশাপাশি অরিজিৎ (চক্রবর্তী) মেতে উঠেছে মোবাইল ফোনের সাহায্যে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি তৈরিতে। এসব তো অবরুদ্ধ সময়ের সৃজন–মশাল। ডিজিটাল দুনিয়ার কত কিছু শিখে নিল এই শব্দশ্রমিকও। কস্মিনকালেও যে ভিডিওগ্রাফি জানত না সেও এখন জেনে গেছে ফোনের সেই কারুকাজ। তৈরি হয়ে যাচ্ছে কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি। কত ছবি, ভাস্কর্য নতুন করে ঢেউ তুলছে হৃদয় নন্দনবনে। ভেসে উঠছে রকমারি সৃজনধ্বনি। কত অপঠিত থেকে যাওয়া বই নেমে আসছে তাক থেকে। এভাবেই সকাল গড়িয়ে সন্ধে, রাত গড়িয়ে ভোর।
যে ভোর নিয়ে আসছে নতুন দিন। লেখা হচ্ছে মানুষে মানুষে জাতপাত, ধর্মের বিভেদহীন, ভয়ডরহীন, নষ্টভ্রষ্ট রাজনীতিহীন, কলুষিত পরিবেশহীন নতুন পৃথিবীর স্বরলিপি। 

লেখকের ছবি : সোনালী চক্রবর্তী  

Post a Comment

3 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  2. আমাদের ছোটবেলা থেকে কিছু প্রোভার্ব মাথায় গেঁথে দেওয়া হয় যেমন 'এক পালকের পাখিরা এক ঝাঁকে ওড়ে' কিন্তু মুস্কিল হলো কেউ বলে না নিজের নিজের দিগন্তে একাকী উড়ালের জন্য ঝাঁক বাঁধতে হয় না,শুধু চিন্তার গাঁটছড়ায় বিরোধ না থাকা টুকুই কাফি । কী সুন্দর পেলাম একটি শব্দ বন্ধ "ভাইরাস ভেলা", জানতে পারলাম এই লেখার সময় ইরফানকে ভাবতে ভাবতে শেয়ার করছিলাম । সবই সেই তরঙ্গ । কোন অবরোধের সাধ্য আছে একে ভাঙার? আমরা আবার ময়ূর পাহাড় যাব দেবাশীষ দা, এর থেকেও সুন্দর ছবি তুলে দেব,শৈশব থেকে কৈশোরের সব স্মৃতি উস্কাব । বড় সুন্দর লিখেছ । খুব সুন্দর ।

    ReplyDelete
  3. Sundar lekha...bhalo laglo

    ReplyDelete