লকডাউনের দিনলিপি

মন বসল না দাঁড়ে

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়


‘দুই পাখি’ কবিতাটা এখন অন্যভাবে বুঝতে শিখেছে লোকটা। বনের পাখি দিব্যি ছিল আকাশে। হঠাৎ সে খাঁচায় পড়েছে ধরা। মার্চ মাসটা গেল তার শুধু ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে। মন বসল না দাঁড়ে। বইয়ের ঘরে এ তাক থেকে ও তাক, ও তাক থেকে সে তাক অস্থির ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে, এটা-ওটা ঠোকরাতে ঠোকরাতে একসময় তার ঘুম পেল। ঘুমের নিয়মেই ঘুম ভাঙল একদিন। ডানাগুলো ঝিমিয়ে এসেছে ততদিনে। সময় তার ছাঁচে ফেলে মানুষকে যেভাবে গড়ে-পিঠে নেয় তারই নাম অভ্যাস। এমনি করেই শরীরের ঘা শুকোয়। মনের উপর সান্ত্বনার প্রলেপ পড়ে। মানুষের মনেরও বোধহয় একটা শরীর আছে! শুধু মন-পদার্থ নেই কেবল ‘তাঁর’! ‘শরীর! শরীর! তোমার মন নাই ভাইরাস?’ লোকটা ভাবে।     
গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে মনে পড়ে না লোকটার সেদিন কী বার? কত তারিখ? দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে মনে হয় সবগুলো তারিখ কে যেন লালরঙে লেপে দিয়েছে। আলাদা করে বোঝা যায় না তাদের। সোম-মঙ্গল-বুধ-বৃহস্পতি-শুক্রে সংক্রমিত হয়ে গেছে রবির লালিমা। সব তারিখ মিলেমিশে যেন প্রকাণ্ড এক মণ্ড পাকিয়ে গেছে! জাদুবাস্তব সেই  ক্যালেন্ডারের ভবিষ্যতের চৌকো ঘরগুলোই শুধু ধূসর, অস্পষ্ট।   
আবহসংগীতের মতো একঘেয়ে ধারাভাষ্য চলে টিভিতে। নতুন নতুন লব্‌জো কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে। বাড়িতে কাগজ ঢোকে না। কাজের লোকেদের ছুটি। ঘনঘন বেজে ওঠে না অফিসের ফোন। মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী পাক্কাবুর্জোয়া লোকটা একবস্তা আলু, সম্ভাব্য আপৎকালীন ওষুধ, বস্তাখানেক চাল আর সংহতি বিপণির পুরনো দু’শিশি ঘি মজুত করার আত্মপ্রসাদে টিভির খবর দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে, মাখতে মাখতে ভাতের গরাস মুখে তুলে চলে।
একসময় টিভিও অসহ্য লাগে। খবর শুনলে মনে হয়, ঝাঁক ঝাঁক অদৃশ্য বুলেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে চলে যাচ্ছে চতুর্দিক। ভয় হয় তার। কে কখন কোথায় লুটিয়ে পড়বে ইয়ত্তা নেই। বাঁচাবার জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না এখন। মারা পড়লেও এগোতে পারবে না কেউ। রিলকে লিখেছিলেন, যেমন-তেমন মরণ কেন হবে আমার? ‘রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি’ মরণে তার রুচি নেই। মরার চেয়েও মরমের ভয় তাড়া করে লোকটাকে। ভয়  ‘খবর’ হয়ে যাওয়ার। ‘অস্পৃশ্য’ হয়ে পড়ার। সর্দিকাশির ধাতটাকে কষে বাঁধতে চায় লোকটা। কেউ যাতে আড়চোখে না দেখে তাকে। নিজেকেই বোঝায় লোকটা, ‘খুঁজে দেখতে চেষ্টা করো তোমার সম্ভাব্য ট্র্যাজেডির ছিদ্রপথ তোমার মধ্যেই কোথাও বাসা বেঁধে  আছে কি না! তোমার বাসরঘরে রয়ে গেছে কি না কোনও বৈবরিক প্রতারণার সূত্র!’             
স্তব্ধ করা হয় ঘ্যানঘ্যানে টিভি। গরম গরম লেবুজল খেয়ে নব্যনিয়তির গাঁই-গোত্র বুঝতে বুঝতে  কয়েক জিবি নেট খসে যায় লোকটার। ‘বিশেষজ্ঞ’ হয়ে ওঠে সেও! ডাক্তার-বিজ্ঞানীদের  নামতাগুলো মুখস্ত হয়ে যায়। সারকথা বুঝে নিয়েছে সে,  ঘনঘন রং বদলানো এই আণবিক  দানব কবে বিদায় নেবে তা দেবা ন  জানন্তি তো ডাক্তার কুতঃ?
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যখন ঝাপসা দেখায় তখন লোকটা ফিরে যেতে চায় অতীতে। অথবা সে   বিহ্বল মুহূর্তে তাকিয়ে থাকে শূন্যে, আকাশে। ছোট-ছোট টুকরো-টুকরো মুহূর্ত চাক বাঁধে স্মৃতিতে। কুড়ি সেকেন্ড কচলানোর পর তাতে ফেনা জমে বিস্তর। বুদবুদগুলো ছোটবেলার মতো বাতাসে উড়িয়ে দিতে থাকে লোকটা। তার শিশুসন্তান ভাবে, বাবা যে আজ আমার মতো  ছোট!
আলস্যে দার্শনিকতা পেয়ে বসে লোকটাকে। মানুষে-মানুষে সম্পর্কের বিন্যাস কেমন হবে আগামী পৃথিবীর? ভার্চুয়াল দুনিয়াতে কি ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষ-সংবেদন থাকে? নতুন কোনও এথিক্সই কি  তবে গড়ে উঠতে চলেছে পৃথিবীতে? উলটে-পালটে যাবে কি বিশ্ব অর্থনীতি? তৈরি হবে নতুন সামাজিক ব্যাকরণ? লোকটা ভাবে।     
পড়া-পড়া, লেখা-লেখা খেলায় দিন কেটে যায় তার। মোবাইল বা ল্যাপটপের পর্দায় অলস সময়ধারা বেয়ে চলে যায় পয়লা বোশেখ, পঁচিশে বোশেখ। আমের কচিগুটিগুলো ডাগর হয়ে ওঠে।  ঝড়ে ঝরে পড়লে বালকবেলার মতো ভোরে উঠে কুড়িয়ে নিতে মন চায়। অফিসের নির্দেশ থাকে ঘরে বসে কাজ করে যেতে। লোকটা ভার্চুয়াল পৃথিবীতে বক্তিমে করে। কখনও বা দূরযোগে রবীন্দ্রনাথ পড়ায়: “রবীন্দ্রভাবনায় ‘আত্মশক্তি’ এক বীজশব্দ। আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।”
ওদিকে পিলপিল করে যক্ষপুরীর সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসে পুঁটুলি মাথায় ৪৭ফ, ৬৯ঙ-র দল।  তারা হাঁটে হাঁটে আর হাঁটে। কী অবিচলিত নিষ্ঠুরতা সেই নিষ্করুণ জার্নি মোটিফে! রাষ্ট্রের হিসাবের খাতায় তারা ছিল বিস্মৃতির অতলে। হাঁটতে হাঁটতে তারা ক্লান্ত হয়। সমান্তরাল রেললাইন কখনও মেলে না পরস্পর। ইস্পাতের রেল হয় তাদের মাথার বালিশ। তারা পাথরে বিছানা পাতে। ক্লান্ত শরীরের উপর দিয়ে ট্রেন চলে যায়। ক্লান্তি ঘোচে তাদের!
লোকটা মনের গ্লানি হাতের সাবানে ধুয়ে ফেলে খেতে বসে। আবার ঘুমোয়। কবে ‘তিনি’ ঘুমোবেন এই প্রতীক্ষায় ক্যালেন্ডারে আবার চোখ চলে যায় জেগে ওঠার পর। লোকটা ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে না কিছুই। সব তারিখ আবার মণ্ড পাকিয়ে যায়। যেমন এই লোকটার মধ্যবিত্ত মধ্যচিত্ত রন্ধ্রপথে ঢুকে মিশে যায় অসংখ্য অগণ্য সে-তুমি-আমি!   

Post a Comment

1 Comments

  1. অসাধারণ রোজনামচা লিখেছেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এর।

    ReplyDelete