লকডাউনের দিনলিপি

আতশবাজির অপেক্ষায়

দ্যুতিমান ভট্টাচার্য


এক অদ্ভুত নীরবতা। জনতা কারফিউ। রবিবার দুপুরবেলা। শুধু রিমোটের বাটনে অসহিষ্ণু চাপ। এ চ্যানেল, সে চ্যানেল। তথ্যানুসন্ধান।
আগত কার অপেক্ষায়? হলিউডি সায়েন্স ফিকশন মুভিতে যেমন। এক দমবন্ধকর অপেক্ষা। রুদ্ধশ্বাস। নেইল বাইটিং।
যেন এক ধার্মিক প্রাণ অনন্ত সময় ধরে মুক্তির সন্ধান চাইছে। যেন কোনও ধর্মভীরু ঈশ্বরের সন্ধান চেয়ে বসে আছে জনম জনমের পথ চেয়ে। জীবন যেন এমনই এক প্রতীক্ষার গল্প। এই নিয়েই স্যামুয়েল বেখট্‌-এর যুগান্তকারী নাটক— ‘ওয়েটিং ফর গডো।’
নিউজ চ্যানেল আর সোস্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ায় সে। উড়ে বেড়ায়। গুজব ওড়ে, আট ঘন্টা পর্যন্ত নাকি থাকতে পারে হাওয়ায় ভেসে। খুঁজে বেড়ায় দুর্বল শিকার।
নাটকের বেখেয়ালি চরিত্রগুলোর মতো অস্বাভাবিক আচরণ করি আমরা। অর্থহীন আর একঘেয়ে একটি বিষয়ের পুনরাবৃত্তি। বিশ্বজনীন। অ্যাবসারড নাটকের মতো আমাদের জীবন তুচ্ছ, উদ্দেশ্যহীন। এক বহিঃশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নির্মোহ বেদনার মিশেলে এক গ্লানিময় সত্তার উপস্থিতি।
টিভির পর্দায় ভেসে আসে বিভীষিকাময় প্রতিচ্ছবি। মানুষের অস্তিত্বের ভঙ্গুরতাকে নিয়ে করে উপহাস। ক্রমে আমরা হয়ে উঠি নিহিলিস্ট। নৈরাশ্যবাদী। জীবনের দুর্বোধ্য ভার বহনে ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ, বিপন্ন। এবং বিচ্ছিন্ন। সোশ্যাল ডিসট্যানসিং দূরে সরিয়ে দেয় প্রেমিকাকে।
রাতের স্তব্ধতা ভাঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। বুক ধুকপুক করে।
কাম্যুর বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস। ‘প্লেগ’। রাতের স্তব্ধতা ভেঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সগুলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন সংক্রমিতদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করে নিয়ে আসে, যা এক হ্রদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারনা করে। পরিবার থেকে কিছুতেই স্বজনদের যেতে দেওয়া হয় না। কারণ এরপর আর কখনোই তাঁরা দেখবে না প্রিয় মানুষটির মুখ। তাদের আর্তচিৎকারে রাতের স্তব্ধতা খান খান হলেও, পড়শিদের ঘুম ভাঙ্গে না, তাদের জানালা দরজা আরও শক্ত হয়ে বন্ধ থাকে। কেউ আসে না স্বজনহারাদের স্বান্তনা দিতে।
কয়েকদিন আগে এক যুবক নিজের শরীরে বহন করে এনেছিল তাঁকে। মিশে ছিল মানুষের ভিড়ে। উত্তাল হয় মানুষ। তাঁর শাস্তির দাবিতে। বেয়িং ফর হিজ ব্লাড। আইসোলেশন। কোয়ারেন্টাইন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। যেখানে বাঁচতে গেলে শ্বাস লাগে। জীবনকাল কত দীর্ঘ আমাদের? কতদূর আয়ু! জীবন না আয়ু— কে বেশি সাংকেতিক? ধরিত্রীর জ্যোতির্ময় ঢেকে দেয় গোপন হন্তারক।
এক সন্দেহের বাতাবরণ। অশান্তি, দাঙ্গা যেন এক স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষায়। দেখালো দমদম সেন্ট্রাল জেল। দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ার বারোটি জেলেও। সংঘর্ষ এড়ানো দায়। আকাশে সিঁদুরে মেঘ।
মহামারী মানে বিচ্ছিন্নতা। মহামারী মানে হাহাকার। কান্না। উন্মাদনা। চেতনাহীনতা।
নাটকে দেখা যায় ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন একটি ধূসর প্রান্তরে কোনও এক মিঃ গডোর জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু তাদের অপেক্ষার কোনও কার্যকরী ফল আসে না। একজন অচেনা সংবাদ বাহক যদিও খবর দেয় গডো আসবে কিন্তু সে আসে না।
এমন যদি হয়, আমরা অপেক্ষায় ছিলাম, আছি, ভবিষ্যতেও থাকব। কোনওদিনই এই অপেক্ষার অবসান হবে না এবং গডো কোনওদিনই আসবেন না।
উপন্যাসে প্লেগ অবশেষে শহর থেকে বিদেয় নিয়েছিল এবং শহরবাসী আতশবাজি পুড়িয়ে মুক্তির সে দিনটি উদযাপন করেছিল।
আকাশ আলোয় আবার উঠবে ভরে। জীর্ণ মতবাদ সব ইতিহাস হবে। পৃথিবী আবার শান্ত হবে। নচিকেতায় বিশ্বাস।
উদযাপনের সেদিনের জন্য আমরা যথেষ্ট আতশবাজি মজুদ করেছি কি?


(লেখক বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে এসপি পদমর্যাদায় কর্মরত। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেন। বিভিন্ন বই ও পত্রিকার প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণও করেন। স্নাতক স্তরের ভূগোলের রিমোট সেন্সিং ও ভূ-জলবিদ্যার ওপর দুটি বইয়ের লেখক।)

Post a Comment

1 Comments

  1. সুন্দর অনুভূতি ... মহামারীর মত শিক্ষক আর হয় না। কতকিছু শিখছি ... তবে আমার দিনলিপিতে কোন পরিবর্তন নেই ... আইসলেসান এ আছি অনেক বছর ... আমার ব্যাতিক্রমিক দিনযাপন এভাবে সারা পৃথ্বী আপন করে নেবে তা ভাবিনি। যেভাবে সারা পৃথিবীর প্রতি অঞ্চলের নিধিগণ এসেছিল, মিশেছিল ভাব ভালবাসার আদান প্রদান হয়েছিল ... ভাষা অন্তরায় হয়নি। আমার ব্যাতিক্রমিক দিনযাপন আমারই থাক... আশা করি
    পৃথিবী তার পুরনো " গুড আর্থ " ফিরে পাক, আঙ্কেল টম তার কেবিনে ফিরুক, নতরদাম গির্জার ঘণ্টা বাজুক, কেনিলুয়ারথ পরিবার সুখী হোক আর ক্যাপ্টেন নিমু নতিলাস নিয়ে নতুন দিগন্তে যাক, আর নমো দেশ বেচার কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করুক।

    ReplyDelete