ব্লগ : ওদের কথা/ ২

ব্লগ : ওদের কথা/ 

মামনির অস্তিত্ব

মঞ্জীরা সাহা


হাতের পাতাগুলো ঠান্ডা হতে হতে একেবারে বরফ হয়ে আসছে। রান সেলাইয়ের সুতো ছেঁড়া কাঁথার নীচ দিয়ে পাগুলো কুঁচকে গেছে।  কাঁথার উপর থেকে বোঝা যাচ্ছে শরীরটা কাঁপছে। রোগা শরীরটা বিছানার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
দিন চৌদ্দ আগে লাস্ট যেদিন স্কুলে গিয়েছিল সেদিন ছিল রবীন্দ্র জয়ন্তী। মম চিত্তে নিতি নৃত্যে নাচটা শুরু করেছিল ওদের পাড়ার পিংকি দাস আর অলোকা মণ্ডল। ওরা টি ভি থেকে ডান্স রিয়ালিটি শো দেখে  শিখে নিয়েছিল নাচখানা।  শুধু ওই টি ভির ড্রেসের মতোন ড্রেসখানা হয়নি। পাজামার উপর ওড়না আর ব্লাউজের উপর আরেক ওড়না কাঁচুলির মতো বেঁধে নাচটা শুরু করতেই সিটি পড়েছিল জোরসে। ঠিক সেই সময়েই লাভ লেটার নিয়ে এই মামনি দাঁড়িয়েছিল মেন গেটটার কাছে। নিজের না অন্যের।
অপুষ্ট একটা শরীর। চোদ্দ বছর বয়সে যে ভাবে বেড়ে ওঠার কথা ছিল তেমনটা ওর বেলা আর হল না। ট্যাড়া দুটো চোখের দিকে ওদের ক্লাসের ছেলেরা সেভাবে কেউ কোনোদিন তাকায়নি। রোগা চেহারাটা নিয়ে এমন একটা পেছন কোণে গিয়ে বসত দিদিমণিদের খুব একটা চোখে পড়ত না। টিফিনের পরে ওকে আর দেখা না গেলেও পরদিন ওকে শাস্তি দিতে হবে কেউ ভাবেনি। ও যে পড়া বলবে এমন আশা কেউ কোনওদিন করেনি। পড়া না পারায় তেমন একটা রাগ ওর উপর গিয়ে পড়ত না। রাগ ঢিল বাদে শুধু শাস্তি টুকু জুটত।  মিড ডে মিলের ক্যান নিয়ে পেছন রাস্তা দিয়ে হেঁটে ফিরে যেত বাড়ির দিকে। বাড়িতে ওর আনা খাবারে  ওর আর ওর ঠাকুরমার দুপুর বেলাটা চলে যেত।
পঁচিশে বৈশাখে পাড়ার বৌদির কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল সাদা লাল পাড় একখানা শাড়ি। শাড়িটা পরে দাঁড়িয়ে ছিল গিয়ে বান্ধবীদের পেছনে। এদিক ওদিক ওর চোখ গেলেও ওর দিকে আর চোখ পড়েনি কারুরই।
পঁচিশে বৈশাখের দিন থেকে গরমটাও যেমন বাড়ছিল মামনির শরীরে শীতটাও বাড়ছিল তেমন। শীতে কাঁপতে কাঁপতে সেই যে বিছানা নিল আর ওঠেনি। রোগীর জন্য ফল জুটেছিল পাড়ার বান্ধবীদের কাছ থেকে। আধা পাকা চার পাঁচখানা আম। আর সেজ দিদির সেরে যাওয়া জ্বরের হোমিও ডাক্তারের থেকে আনা ঘরে পড়ে থাকা পুড়িয়া। পাঁচ মেয়ের পর এই মেয়েটি হওয়ায় নিন্দে অনেক হলেও সুবিধে হয়েছিল একটাই। দিদিদের পড়ে থাকা ছোট হওয়া জামায় ওর চলে যেত। আজ ইস্কুলে যখন কোরাসে গান গাওয়া চলছিল ও চলেছিল চারজনের কাঁধে। হরি ধ্বনির আওয়াজটাও হচ্ছিল বড্ড আস্তে।
মামনির বাবা পাঁচ মেয়ের বাবা হয়েও পূর্ব পুরুষদের সুনাম করেছে বাংলা খেয়ে মোড়ের মাথার বেঞ্চে বসে। নিজেই লিভার পচে মরবে এবার ভেবেছিল পাড়ার সবাই। মরেনি। মরেছে ওর এই ছোট মেয়েটা। আর তার  চার বছর আগে পেটের ছেলে পেটেই মরেছিল উচ্চবংশের এই পুত্রের লাথিতে।
মামনির জন্মে বাড়িতে অন্নপ্রাশন হয়নি। শ্রাদ্ধও হল না। পুকুর ঘাটে  গিয়ে নম নম করে কাজ হয়েছে। মামনি কবে যেন বড় হয়ে গেছিল। কারুর চোখ না পড়লেও ওর ওই ট্যাড়া চোখ দুটোও সাইজে বড় হয়ে গেছিল । ও মম চিত্তে নিতি নৃত্যে  রিয়ালিটি শো-এর মতো নাচতে শেখেনি। ও কে দেখে কেউ কোনোদিন সি-টি বাজায়নি। ওকে কেউ লাভ লেটার ছুঁড়ে মারেনি। ক্লাস রুমের দরজার পিছনে অন্ধকারে কেউ টেনে ধরেনি।
মামনি ক্লাসে বাড়িতে খেলার মাঠে মিড ডে মিলের ঘরে ইস্কুলের প্রোগ্রামে আছে কি নেই সেটা নিয়ে কেউ কোনওদিন ভাবেনি। ও কি ভেবেছিল! ও কি একবারও নিজেকে নিজে ছুঁয়ে দেখেছিল? ঠান্ডা শক্ত হওয়ার আগে গরম শরীরটাকে একবারও?




Post a Comment

1 Comments

  1. এত নিপুণ কারিগরের মতো লেখো। খুব ভালো

    ReplyDelete