রবিবার

রম্যরচনা

থিওরি অব রিলেটিভীতি

সুমন গোস্বামী



ক্লাসে ঢুকেই লাহাবাবু চশমার ফাঁক দিয়ে একবার গোটা ক্লাসটা  মেপে নিলেন, তারপর চড়া গলায় বললেন, ‘‘শুভ বলতো রিলেটিভ ক্লজ কাকে বলে?’’
শুভ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল স্যার, ‘‘রিলেটিভ মানে আত্মীয় আর ক্লজ মানে নখ, এককথায় আত্মীয়দের নখ যা আমাদের নরম মনের পলি মাটিতে আঁচড় কাটে, কখনও রক্তও বের হয়ে যায়।’’
পঞ্চাশোর্ধ্ব  কৃষ্ণরূপ লাহা এসব পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত, বিশেষ করে শুভ ছেলেটিই এমন। অদ্ভুত সব দার্শনিক উত্তর দিয়ে থাকে, অথচ পড়াশুনাতে লবডঙ্কা। শুভর বাবার কাছে নালিশও করেন, কিন্তু ওর বাবা বিশিষ্ঠ ভদ্রলোক। উনি বলেন— ‘‘আমি আর কী বলব? আমি ক্লান্ত আপনারা যা করার করুন।’’
ক্লাস শেষে লাহাবাবু চশমাটা মুছে এগোলেন। স্কুল শেষ, এখন শেষ বিকেল, সূর্য ডুবে যেতে যেতেও একবার পৃথিবীর গায়ে হলুদ করে দিচ্ছে। লাহাবাবু হেঁটেই বাড়ি ফেরেন, আজ শুভর কথাটা ওনার মনে একটা ছাপ ফেলেছে। কত কথা মনে আসে ওনার। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্র উনি। প্রথমা স্ত্রী মারা যান, স্ত্রী গাছে ফল ধরার আগেই। বহুদিন বিয়ে থা করেননি, কংগ্রেসী আমলে শিক্ষকতার পাশাপাশি ছিল একটা সাপ্তাহিক কাগজ। তো সেই কাগজে নিয়মিত চলত সরকার ভজনা। কারণ আর কিছু নয় যদি ভাইদের একটা গতি হয়। তা ভাইদের চাকরি বাকরি জুটিয়েও দেন। নিজের কথা ভাবেননি। সবার জমিই রেজিস্ট্রি হয়, সবাই জমিজমা বুঝে নেন কিন্তু উনি আর জমি জমা নিয়ে মাথা ঘামাননি, বিয়েই যখন হল না, তারপর একদিন পঞ্চাশ বছরের জীবনেও বিয়ের ফুল ফুটল। তিনি গেছিলেন এক পণ দিতে না পারায় লগ্নভ্রষ্টা হয়ে যাওয়া মেয়ের খবর তুলে আনতে, তো খবরের সাথে সাথে মেয়েটিকে বধূ রূপেই তুলে আনলেন। কৃষ্ণরূপ ওর মামাদের মুখ থেকে শোনেন সেদিন লাহা বাড়ির উঠোনে সাইক্লোন বইছিল। যে ছোটভাই কে চাকরি করে দিয়েছিলেন প্রাইমারি স্কুলে, তিনি বলে উঠেছিলেন ‘‘বুড়োর এই বয়সে রস জেগেছে।’’ আরেকভাই যাকে চাকরি করে দেন বিএলআরও অফিসে সে তো বলেই দেয়, ‘‘বেজাতের মেয়ে ঘরে উঠতে দেব না’’। সেই রাতেই ঘর ছেড়ে মন্মথবাবু, কৃষ্ণরূপের বাবা ওঠেন তাঁদের কুলদেবতার মন্দিরে। দিন যায়, পঞ্চান্ন বছর বয়সে সন্তানের মুখ দেখেন উনি। টুপ করে জন্ম হয়ে যায় কৃষ্ণরূপের অনেকের মুখ আঁধার করে। ভায়েরা সেদিন কি হাসাহাসিই না করে। সবাই মিলে ছেলের মুখ দেখতে আসে, তির্যক হেসে এক ভাই তো বলে বসে ‘‘বাবার ছবিতে মালা দিয়ে মাধ্যমিক দিতে যেতে হবে আহারে।’’ তা সেই ছেলেও বড় হল, মাধ্যমিক দিল, মনে মনে ভাবেন কৃষ্ণরূপ। কত কথা মনে আসে, বাবার অবসরের একমাস পর, তখন পেনশন চালু হয়নি, রাত্রে ওরা খাচ্ছিল, প্রনম্য ন কাকা এসে বলে ‘‘কি রে ওমলেট খাচ্ছিস, জল দিয়ে ভাজা নাকি রে? ফ্যাটফ্যাটে সাদা! ও! কম তেলে খাওয়া অভ্যাস করছিস বুঝি? ভালো। ভালো।’’ মুখে চাপা হাসি। মনে আছে মা খুব কেঁদেছিল। সেই কান্নার শব্দ এত বছর পর উনি পরিষ্কার শুনতে পেলেন। মনে আছে, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার আগেই বাবার শরীরে বেদনার নীল ফুল ফুটেছিল। ডাক্তারি ভাষায় তাকে বলে কর্কট। একটু একটু করে ওর বাবা বিছানায় মিশে যাচ্ছিল। অর্থকষ্ট হয়েছিল খুবই, লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে মাকে চিকিৎসার খরচের জন্য যেতে হয় ছোটকাকার কাছে, তিনি আশ্বাস দেন ব্যবস্থা হবে। একদিন সকালে বাবা বারবার বলছিল এ যন্ত্রণা সহ্য হয় না, এর চেয়ে একটু বিষ দে।’’— ছোটভাই পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিল ‘‘চিন্তা কী? কেমোর ব্যবস্থা আমি করব। স্টেশনের কাছের জমিটা আমার নামে লিখে দাও।’’ বড় কষ্ট পেয়ে বিদায় নিয়েছিল কৃষ্ণরূপের  বাবা।
আচ্ছা এসব কথা মনে আসছেই বা কেন ওনার? একি সেই রিলেটিভ ক্লজের প্রভাব? মনে মনে হাসল কৃষ্ণরূপ। ঘনিষ্ঠ আর অনিষ্টর মধ্যে একটা দারুন কেমিস্ট্রি আছে কিন্তু। ওনার মনে পড়ে সেইসব আততায়ীর মুখ, যারা উচ্চমাধ্যমিকে তার পড়াশুনায় সাহায্য করতে তো আসেইনি বরং তাকে অনুৎসাহিত করে সায়েন্স নিতে। তারাই রেজাল্ট বের হবার দিন দলে দলে আসে রেজাল্ট জানতে। মনের গভীরে একটাই কামনা ধারন করে। এরা সব হিপ পকেটে বাঘ নখ রাখা পাবলিক। খুড়শ্বশুরের কথাও মনে পড়ে ওনার, উনি ছিলেন এসডিও। বিয়ের ঠিক পরেই পুজোয় তাঁর জন্য উনি কিনেছিলেন ভ্যান হুসেইনের শার্ট, কিছুদিন পর অপর দিক থেকেও এসেছিল একটা জংলিছাপের জামা, সচরাচর ফুটপাতে কম পয়সার যে সব জামা আমরা ঝুলতে দেখি। আসলে উনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তুমি এটাই ডিজার্ভ করো বাবু। সেদিনের সেসব অন্ধকার পেরিয়ে কৃষ্ণরূপ এখন নিজেও স্বাবলম্বী, গ্রামে তিনতলা বাড়ি, গাড়ি, ছেলে কলকাতায় কলেজে পড়ায়। কৃষ্ণরূপ লাহার জীবনে এখন আলোই আলো। কৃষ্ণরূপের খেয়াল হল, বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছেন। বাড়িতে ঢোকার মুখে লেটার বক্স থেকে উঁকি মারা চিঠিটা নিয়ে, ঘরে ঢুকলেন উনি। ফ্রেশ হয়ে, চেয়ারে বসে চিঠিটা খুললেন, মুখের উপর একটা ঊর্ণণাভ যেন জাল বিস্তার করল। চিঠির শেষ কথাগুলো এরকম— ‘‘বাবা ফ্ল্যাট আমাকে কিনতেই হত, আরাত্রিকার পক্ষে গ্রাম্য পরিবেশে থাকা সম্ভব নয় তুমি তো জানোই। আর শোনো, তোমাদের ফ্ল্যাটের ছবি পাঠাব। আমি আসলে ফ্ল্যাটের কথাটা বলতে ভুলেই গেছিলাম। প্রণাম নিও। তোমাদের ঋজু।’’
কৃষ্ণরূপের স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন। ‘‘চিঠিতে কী লেখা গো?’’
কৃষ্ণরূপ বললেন ‘‘আঁচড়।’’
‘‘কীসের?’’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কৃষ্ণরূপ বললেন ‘‘রিলেটিভ ক্লজ।’’

Post a Comment

6 Comments

  1. হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছিলাম বিছানা থেকে। ��������������

    ReplyDelete
  2. এই যে রম‍্যরচনা পড়তে পড়তে চোখ ভিজে উঠল...এখানেই তুমি জিতে গেলে। অনবদ্য।

    ReplyDelete
  3. গল্পটার শুরুথেকে ধীরে ধীরে আঁচড়টা স্মিতহাসির মুখ থেকে বুকে পড়ল।

    ReplyDelete
  4. এরকম রম্য!! যাক আঁচড় তো পড়লই। দারুন!

    ReplyDelete
  5. থিওরি অব রিলেটিভীতি আনবদ্য ।

    ReplyDelete