লকডাউনের দিনলিপি

অশ্বত্থকে আলিঙ্গন

অভিমন্যু মাহাত


জৈড় গাছ, যা বাংলা অভিধানে অশ্বত্থ নামে অভিহিত। স্নানের পর এই জৈড় গাছের গোড়ায় জল ঢালেন আদিবাসীরা। পুরুষেরা জল ঢালার পর আলিঙ্গন করেন। আর মহিলারা ষাটাঙ্গ প্রণাম করেন। চারা হোক বা পূর্ণাঙ্গ জৈড় গাছ, গোটা বৈশাখ জুড়ে প্রতিদিন এই রীতি পালন করেন আদিবাসীরা। এখন প্রশ্ন উঠবে কেন এই রীতি? অরণ্যের প্রতি, গাছের প্রতি মমত্ববোধ প্রতিধ্বনির লক্ষ্যেই আদিকাল থেকে এই প্রথা চালু হয়ে আছে। যে বৃক্ষের মানব সভ্যতার প্রতি বিপুল অবদান, জল- বায়ু- মেঘ যে আনে, তাকে ঘিরে কোনও রীতিনীতি থাকবে না? বেঁচে থাকার জন্য আদিবাসীরা বৃক্ষের অবদানকে উপলব্ধি করতে পেরেছে বলেই বৃক্ষকে ঘিরে নানান পূজা পার্বণ। বৈশাখ মাসের পরেও সারা বছর ধরে নানান বৃক্ষ বন্দনার রীতি রয়েছে ফাইভ জি যুগেও বহাল আছে। আদিবাসী গাঁয়ে এখনও মেয়েরা বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় সবচেয়ে প্রাচীন যে জৈড় গাছ, তার কাছে গিয়ে প্রণত হয়। একইভাবে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে ঢোকার আগে গ্রামের প্রাচীন গাছের কাছে দণ্ডবৎ হয়, তবেই পিত্রালয়ের মাটিতে পা রাখার অনুমোদন মেলে। মেয়েদের এই প্রণত হওয়া, শুধু বৈশাখ মাস নয়, বছরভরের কালচার।
বৈশাখ মাস জুড়ে জৈড় গাছের গোড়ায় জল ঢালার আরও একটি দিক খুঁজে পান অনেকে। বৌদ্ধধর্মে মূর্তি পূজা নেই। আদিবাসীদেরও দেবতা মূর্তিতে আবদ্ধ নয়। ফলে বৌদ্ধধর্মের একটি অনুসঙ্গ হয়তা বা প্রভাবিত করেছিল মূলবাসীদের। গৌতম বুদ্ধ অশ্বত্থ বা জৈড় গাছের নিচে বোধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অমিতাভ বুদ্ধের সেই বোধিলাভকে স্মরণ করতে গিয়েই হয়ত বৈশাখ মাস জুড়ে জৈড়কে জলদান করেন আদিবাসীরা। এ এক কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসাবেই চর্চিত।
অরণ্য বা বৃক্ষের প্রতি প্রেম একদিনে জন্মায় না। সত্যি বলতে কি এযেন স্থায়ী স্মৃতিতে ঢুকে পড়া এক সংস্কার। যা গাছের শেকড়ের মতোই বহমান থাকে বংশপরম্পরায়। বহুশতাব্দী পরে এক বৈশাখে দেখা হয়েছে নগর সভ্যতা আর মহামারীর। পয়লা বৈশাখ থেকে প্রান্তজনেরা জৈড় গাছে জল ঢালতে শুরু করেছে। প্রকৃতির কাছে তার আহ্বান, বিষমুক্ত করো পৃথিবীকে। আদিম পৃথিবীতে ভাইরাস বিষ হিসাবেই চিহ্নিত ছিল। প্রান্তজনেদের কাছে একটা শিক্ষা কি নতুন বছরে নিলে ইগো আহত হবে আধুনিক সভ্যতার? সে জখম কি করোনার থেকে বেশি প্রাণঘাতী হবে? পৃথিবীর অসুখ সেরে যাবে একদিন, সুখের অসুখের ভবিষ্যৎ কি, লকডাউনের দিনগুলিতে সেই ভাবনাই বারবার কাঁটা হয়ে দংশন করে যাচ্ছে। করোনার মতোই!

Post a Comment

0 Comments