লকডাউনের দিনলিপি

যেন লকআউট, কিন্তু এখন?

সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়


‘লকআউট’ কথাটা ছোটবেলা থেকেই শুনেছি। লাল শালুতে বাঁধা সেই শব্দের মধ্যে চটকলের ভোঁ ছিল। হঠাৎ করে কোন একটা ‘ভোঁ’ কেমন চুপ হয়ে যেতো। জানতে পারতাম ‘তিন নম্বর জুটমিল’ লক আউট হয়েছে। কিছুদিন বন্ধ লোহার বড়ো গেটে বাঁধা থাকতো লাল পতাকা, সামনে বসে থাকতো শক্ত চোয়াল, শুকনো মুখের কিছু মানুষ। তারপর অ্যামবাসাডার-দুধসাদা ধুতি আর সাইকেল-কোঁচকানো পায়জামার মিটিং হতো। খুলে যেতো লকআউট।
লকডাউন শুনে প্রথমদিকে সেই লকআউটের কথাই মনে হচ্ছিল, অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম দীর্ঘায়িত লকআউটের শ্রমিকদের মতো। মনে আশঙ্কা ও হতাশা আসলো দ্রুত। বিগত দশকগুলোতে যেমন গঙ্গার দুই তীরের বন্ধ কারখানার চিমনির মাথায় গজিয়েছে অশ্বত্থের চারা, তেমনি কি আবার প্রকৃতির দখলে চলে যাবে উচ্ছ্বল জনপদ, মুখরিত বিপণি, ক্লাসের বেঞ্চ, খেলার মাঠ! চেনা ফোন বেজে যাবে, উত্তর আসবে না!
দু’ একদিন চ্যানেলে চ্যানেলে আতঙ্কের খবর শুনলাম। ঠিক যেন লোকসভা নির্বাচনের বিশ্লেষণ। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সবাই সমান বিজ্ঞ অথবা সমান বেপরোয়া। ‘কী করে তাড়াবো করোনা’ সেটা না ভেবে সবাই যেন ‘আমরা কি চা খাবোনা’ বলে মেতে উঠলো। রোজ-বাজারের বাঙালি হুজুগ আর ফেসবুকের পাতায় রান্নার উৎসব দেখে মনে হল ‘ধুত্তোর!’
এসব ভাবতে ভাবতেই, করোনা নিয়ে টেলিভিশনে সান্ধ্য তরজার শব্দের মধ্যে চটকলের ভোঁ কানে এল যেন! হঠাৎ করে কোনও একটা ‘ভোঁ’ চুপ করে গেল কী...!
কোন কন্দরে লুকিয়ে থাকা চিঠির বান্ডিল আর হারিয়ে যাওয়া জীবনের কিছু ছবির ঝাঁপি উঠে এল হাতে। লাগামছেঁড়া কৈশোর থেকে হঠাৎ করে নিয়মের লাগামে-রেকাবে আটকে পড়া ফৌজি যৌবন হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলো। ফেসবুকের কল্যাণে একে একে উঠে এল সেই সব হারানো মুখেরা, অনেকের সঙ্গে হয়তো দেখা হয়নি বত্রিশ বছর। ব্যাঙ্গালোরে, ভারতীয় বায়ু সেনাবাহিনীর এক ট্রেনিং সেন্টারে, আজ থেকে চৌত্রিশ বছর আগে অচেনা অনেকের সঙ্গে আমিও পৌঁছেছিলাম বাড়ির জন্য মন কেমন করা বিষন্ন এক বিকেলে। দু’তিন দিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম আমরা আর কেউ ‘ব্যক্তি’ নই, আমরা সবাই নতুন পরিচয়ে এক ‘সমষ্টিমাত্র’। নতুন জন্ম হল, নতুন মা বায়ূসেনার গর্ভে। সহোদর হিসেবে পেলাম অসংখ্য ভারতসন্তান যাদের মধ্যে শতাধিক বাংলাভাষী। অনেকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, কিন্তু ট্রেনিং এর পরে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়া আরও অনেকে হারিয়ে গিয়েছিল একে অন্যের কাছ থেকে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এই লকডাউনের নির্বাসনে যোগাযোগের জাল ছড়াতে লাগলো। যথারীতি তৈরি হল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ।
একে একে হারিয়ে যাওয়া মুখেরা ছবি দিল নিজের এবং পরিবারের নতুন সদস্যদের। মাঝখান থেকে কেউ বলে উঠলো, ‘ওরে, চিনতে পারছি না, তোর সেই সময়ের ছবি দে!’— টাক মাথা, গুঁফো লোকটা ছবি দিল একটা কদমছাঁট বাচ্ছা ছেলের, যে চাকরি করতে এসেছিল বাবার কাছে সই নিয়ে, কারণ তার বয়স ছিল সতেরো বছর মাত্র।
দু’একজন এখনও আছে বায়ুসেনার চাকরিতে, অবসরের দোরগোড়ায়। আর সবাই চলে গেছে ব্যাঙ্ক, রেল, গোয়েন্দা সংস্থা, শিক্ষকতা, জাহাজঘাটায়, ব্যবসায়। ছড়িয়ে পড়েছে দিল্লি, দুবাই, পুনে অথবা কোনও পাড়াগাঁয়।
কিন্তু ইন্দ্রনীল আর হাদিসকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিক ওদিক থেকে খবর এল কয়েকজন বন্ধু আর কোনওদিন আসবে না— কেউ রোগে, কেউ গুলিতে আর কেউ বাইকের তীব্র গতিতে...!
‘এই বুড়ো তুই খোঁজ্ ওদের!’ বেশি বয়সে চাকরি করতে গেছিলাম (তখন কুড়ি) তাই ছেলে ছোকরার দল ওই নামেই ডাকতো। তাদের গঞ্জের নাম মনে ছিল তাই গুগলবাবার স্মরণ, পঞ্চায়েত, পুলিশ স্টেশন, এলাকার ফেসবুকের সদস্যদের বিরক্তিভাজন হয়ে অবশেষে খড়ের গাদায় ছুঁচ খুঁজে পেলাম। একজন আধ্যাত্মিক পথে অন্যজন পড়াশোনা নিয়ে এমন আত্মমগ্ন যে সকলের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। এই করোনা-দিনে তারাও এল ফিরে। সকাল থেকে রাত যে যখন পারছে, পুরানো ছবি আর স্মৃতির পোস্টার লাগাচ্ছে দেয়ালে।
বন্ধুরা সবাই আজ বিভিন্ন সমাজসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। একে অন্যের সংস্থার জন্য টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। সেদিনের সেই গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর ট্রেনিং আবার নতুন করে লড়তে শক্তি দিল। থ্যাঙ্ক ইউ এয়ার ফোর্স। জয়হিন্দ। 

Post a Comment

7 Comments

  1. বাহ্, ভাল লাগলো। লেখাটার ইতিবাচক দিশাটাই আনন্দ দিল।

    ReplyDelete
  2. Excellent. দারুণ!

    ReplyDelete
  3. এসবে মন ভরবে না। যেটা আপনার কাছ থেকে পেতে চাই সেটা শুরু করেছেন কি?

    ReplyDelete
  4. দারুন।। মনের অনেক গভীরে হারিয়ে যাওয়া সেই রত্নভান্ডারের দরজা খুলে দিলি ভাই।।

    ReplyDelete
  5. অনবদ্য রচনা। প্রাক্তন সেনাকর্মির ছেলে বলে বোধহয় আরও বেশি ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  6. এতো রত্ন ভাণ্ডারের হদিশ পেলাম মনে হল‌। চমৎকার।

    ReplyDelete