লকডাউনের দিনলিপি

নিঃসঙ্গের আলোবাতাস

নাসিম-এ-আলম


স্পর্শ দোষে একাকীত্ব। একাকীত্ব থেকে স্মৃতিহীনতা। সেই অসুখের চিকিৎসাও আছে, তবে সংক্রমণ ও হয় দ্রুত। এমনই জানিয়েছেন গ‍্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, তাঁর নিঃসঙ্গতার
শতবর্ষ উপন্যাসে। নিঃসঙ্গতার সংক্রমণ হয় কিনা জানি না তবে একাকীত্ব থেকে স্মৃতিহীনতার অভিজ্ঞতা চোখ মেলে দেখলে বোঝা যায়। ছেলে মেয়ে প্রতিষ্ঠিত, বিদেশে আছে, মা-বাবা একাকী সংসারে। এদের মধ্যে কেউ একজন ইহলোক ছেড়ে গেলে, অন‍্যজন কথা বলবেন কার সাথে? প্রেত নিঃসঙ্গতার ভিতরে একটাই সান্ত্বনা ছেলেমেয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। দূরে কোথাও নীল আকাশের দিকে চেয়ে অস্ফুট বলে ওঠা, 'ভাল থাকিস খোকা'। এখন তবুও মাসে এক আধবার ফোন আসে, যখন চিঠিই ভরসা ছিল তখন দুপুর জোড়া অপেক্ষা, কখন ডাকপিয়নের পদধ্বনি শোনা যাবে! অনেক কষ্টে এটাই আমাদের অর্জন। সাফল্যের মার্কশিট।
ক্রমাগত ইঁদুর দৌড়ের ভিতর এতদিন পিছন ফিরে দেখার অবকাশ হয়নি, পুরোনো বন্ধুদের মুখ, কৈশোরের ঘুড়ি ওড়ানো, মারবেল খেলা, বৃষ্টি ভেজা দুপুর, স্টেশনের কাছে মন উচাটন কৃষ্ণচূড়া, তার বদলে বেতন, ইনক্রিমেন্ট, ফ্ল্যাট, ই এম আই, কাছে, দূরে ভ্রমণ, সন্তানের ইংলিশ মিডিয়াম, থমকে দাঁড়ায় যে  সে পরাজিত!
অথচ আজ যখন থমকে যেতে হয়েছে, বন্ধ হয়ে গেছে দক্ষিণের জানালা, তখনই হঠাৎ মনে হল নীরার সাথে কতকাল দেখা হয়নি। কতদিন শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়িনি, বিভূতিভূষণ ওল্টায়নি বহুদিন। কিংবা ঐ যে বিস্তারিত মাঠ ওখানে ঘুড়ি ওড়াতাম আমরা, এখন ওখানে বাড়িঘর হয়ে গেছে, বাবার হাত ধরে ক্লাসের নতুন বই কিনে ঘরে ফেরার পথ ও পাল্টে গেছে। এখন কি বৃষ্টিতে ভেজে প্রেমিক যুগল, নাকি ওরা কোচিং নিতে গেছে একা, ফিরবে একা, কেরিয়ারের চেয়ে বড় কোনও ভালোবাসা নেই বোধহয়!
কবি উপন্যাসে নিতাই কবিয়াল বলেছেন, জীবন এত ছোট ক‍্যানে? জীবন ছোট অনস্বীকার্য আর আমাদের মনের পরিসর! এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকের অমল, বিমলের মতো একঘেয়ে। সামাজিক ভাবনা নয় আমরা নিরাপত্তা খুঁজি। নিজের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হলে অতঃপর পরচর্চা। মাসতুতো, পিসতুতো ভাইবোন, দেখা হয় না, বাড়ির বয়স্ক কারও মৃত্যু একটা সুযোগ করে দেয়। শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে একবেলা সকলে একসাথে। শোকহীন একটা গেট টুগেদার।
আলোবাতাসহীন জীবনে, না-চাওয়া ছুটির ভেতর আমাদের আত্মসমীক্ষা। একবার সভ‍্যতাকে না হয় পেছনে ফিরে দেখি! রবীন্দ্রনাথের গানের ভেতর জীবনকে খুঁজি, খুঁজে দেখি শোক, সুখ, বিরহ, প্রেম, আনন্দ, বিষাদ। শীত-বসন্ত-বর্ষার প্রকৃতির মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করার সুখ।
গত সন্ধ্যায় কীর্ণাহার চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখলাম দূর পশ্চিম অবধি। অবসন্ন অন্ধকার। দু-একজন মানুষ, সাইকেলে, কেউ পায়ে পায়ে।
অন্য সময় হলে এই ছোট মফস্বল গমগম করতো, পশ্চিমের নিঃসঙ্গ পথের দিকে তাকিয়ে মনে হল এই পথ ধরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আসতেন কীর্ণাহার, তাঁর আত্মীয় বাড়ি এখানে। এখান থেকেই 'না' বড়গল্পের রসদ পান লেখক, পরবর্তীতে 'না' সিনেমায় রূপ পায়। সাহিত্যিক অবধূত কীর্ণাহার নিকটবর্তী মুন্ডমালিনী আশ্রমে ছিলেন দুবছর। বিকেলে পায়ে হেঁটে এখানে আসতেন সেসময়ের কীর্ণাহার শিবচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রামশম্ভু গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি। স্মৃতি কাতরতা থেকে বাস্তবে ফিরি। অভাবী মানুষ, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে নতুন প্রজন্ম। চাল, ডাল, খাদ্য বিতরণ, রুগীদের পাশে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা পরিসেবা পাইয়ে দেওয়া সবকিছু‌। মনে হচ্ছে কোথাও ভাঙন হলেও নির্মাণের ছবিও স্পষ্ট। মন ভাল হয়ে যায়। আর যারা চোখ বন্ধ করে সমালোচনা করছেন, গৃহে সুখে আছেন, অর্থ চিন্তা নেই, মনে হচ্ছে তারা বেশ মজা পেয়েছেন। টেবিলে লোভনীয় খাবার সাজিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন কেউ, কেউ‌। অথচ হাজার, হাজার মানুষ বাড়ির বাইরে, তারা পেটপুরে খেতে পাচ্ছেন না। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এই বিপদে গুজব ছড়াতেও দ্বিধা নেই অনেকের। রূপচর্চার উপায় বাতলে দিচ্ছেন অনেকে। হাসিমুখে গান গাইছেন আর অনবরত তা বিতরিত হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
মহাভারতে নৃশংসতার বর্ণনা দিতে গিয়ে ভীষ্মপিতামহ খুন, রাহাজানি, ডাকাতির কথা বলেননি, তিনি বলেছেন যে অভুক্তের সামনে লোভনীয় খাবার সাজিয়ে রাখাই চরম নৃশংসতা। হয়তো এভাবে নতুন, নতুন উপলব্ধি হচ্ছে আমাদের। লকডাউন উঠে যাবে একদিন, পৃথিবী আবার শান্ত হবে, কিন্তু আমরা এতটুকু নিজেদের শুধরে নেব কি?

Post a Comment

0 Comments