লকডাউনের দিনলিপি

আশা ঘিরেই বেঁচে থাকা

অনির্বাণ দাশগুপ্ত


ডাক্তারি জীবন ২৫ বছর হলেও মানবজীবন স্বাভাবিকভাবেই তার চেয়ে কিছুটা বেশি। সুখস্মৃতি হয়তো হাতেগোনা, কিন্তু অদ্ভুত স্মৃতি মাত্র দুটি। প্রথমটি এমার্জেন্সি… যদিও তখন আমি যথেষ্টই ছোট কিন্তু কেন জানি না জীবনের সেটাই প্রথম মানব রচিত নির্জনতা। রাস্তাঘাট শুনশান… আর্মি ট্রাকের চাকার শব্দ… পাশের অবাঙালি বাড়িতে রেডিওতে খবর… সংবাদপাঠকও যেন খবর পড়তো চাপা গলায়… যদি কেউ শুনে ফেলে!

দ্বিতীয় স্মৃতি বুঝতেই পারছেন, ভাইরাস শাসনের ছন্দে নিজের জীবন ছন্দে ব্রেক লাগানো। হোয়াটসঅ্যাপে খবর পেলাম বিদেশের এক শহরের বিছানায় সপরিবারে শুয়ে শোভনদা… ডাক্তার শোভন নন্দী— আমাদের থেকে তিন বছরের সিনিয়র, জ্বর, গায়ে ব্যথা, অস্বাভাবিক দুর্বলতা নিয়ে। সরকার বাহাদুর বলেছেন মাইল্ড সিমটমে হাসপাতালে আসার দরকার নেই। পাশে ছেলে… আজ জ্বর কম। পাশের ঘরে রুমা… শ্বাস কষ্ট নেই, কিন্তু ভীষণ গায়ে ব্যথা। সরকার নির্দেশিত ওষুধের বাইরে কিছু খাওয়া যাবে না। তুমি ডাক্তার হলেও এখন তুমি রোগী। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে খবর দেবেন, অ্যাম্বুল্যান্স এসে তুলে নিয়ে যাবে। ভেন্টিলেটর খালি থাকলে আপনি পাবেন… অবশ্য আরেকটি ক্ষেত্রে সেই শ্বাসযন্ত্র আপনি পেতে পারেন… যদি দেখা যায় আপনি ভেন্টিলেটর পেলে বেঁচে যেতে পারেন, সে ক্ষেত্রে অবশ্য আপনার মুখে লাগানোর জন্য যন্ত্র খুলে নেওয়া হবে তার মুখ থেকে, যার বয়স ৭০ এর বেশি… আরে বাবা বাঁচার চান্স তো তার কম, আর রাষ্ট্রের কাছেও সে মূল্যহীন। অবশ্য এই পর্বে মোটামুটি অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠে ওরা… এটাই সুখস্মৃতি, খবর পেয়ে বিবাহবিচ্ছেদের আট বছর পর ঋতপা ফোন করেছিল… জানতে চেয়েছিল আগের মতো এখনও জ্বরের ঘোরে শোভনদা কারও বুকে শীতলতা খোঁজে কিনা!

১৯৭৯ সালের এক সন্ধ্যায় রেল কোয়ার্টারের উঠোনে বসে আছি বাবার সাথে… লোডশেডিং… হ্যারিকেনের আলো তখনও জ্বলেনি। অসহ্য গরমের মধ্যে দূরে এক্সপ্রেস ট্রেনের দাদরা। বাবা শেখাচ্ছিলেন লেফট্যানেন্ট শব্দের বানান মনে রাখার মিথ্যা-তুমি-দশ-পিঁপড়ে রহস্য… আকাশে কালপুরুষ চোখ টিপে বলেছিল মনে থাকবে তো? হঠাৎ ঘরের এইচএমভি কাঠের রেডিওতে, সম্ভবত নীলিমা সেন জানালেন, সেদিনই ভোরে ফাঁসি হয়ে গেছে জুলফিকার আলী ভুট্টোর। বাবা যেন থমকে গেলেন… বিড়বিড় করে বললেন ‘হত্যা কখনও সত্যকে চাপা দেয় না, শুধু তার প্রকাশকে কিছুটা বিলম্বিত করে।’ এই কথাটাই মাস দু’য়েক আগে হঠাৎ মনে পড়ে গেল যখন আমার এক কোরিয়ান ডাক্তার বন্ধুর মুখে শুনলাম, আমাদের শেষ বুসান(দক্ষিণ কোরিয়া) কনফারেন্সে আলাপ ১২ জন চীনা চিকিৎসক বন্ধুর কোনও খবর নেই… ফোন ডেড!

চীনের দেড় লক্ষ নীরব মোবাইলের মধ্যে ১২ হয়তো এক ছোট্ট সংখ্যা, কিন্তু বড্ড সরব আমাদের স্মৃতিতে। ছোট ছোট চোখ, সবাই প্রায় একরকম দেখতে, অদ্ভুত ভাষা— কিন্তু বড্ড প্রাণবন্ত। কিন্তু সরব শরীর রাষ্ট্রের পক্ষে হয়তো সবসময় নিরাপদ নয়। নয় প্রার্থিত।

এই হত্যা লীলায় ভাইরাসের কিন্তু কোনও অনুতাপ নেই, আত্মসুখও নেই। বংশ বৃদ্ধি অথবা আপন খেয়ালে সংখ্যা বৃদ্ধির তাগিদে মরছে মানুষ। একদিন ভাইরাসও বুঝতে পারবে বেঁচে থাকার জন্য মানব শরীর প্রয়োজন। কারণ মানব শরীরের বাইরে ভাইরাস জড় পদার্থ। সেদিন সে থেমে যাবে। মানুষও হয়তো খুঁজে পাবে সঞ্জীবনী। অপেক্ষা আর দূরত্ব ছাড়াও অন্য কোনও অস্ত্র আমাদের হাতে তুলে দেবে কোনও মেধা। সে আশা ঘিরেই আমাদের বেঁচে থাকা… আমাদের জীবন।

Post a Comment

7 Comments

  1. অসাধারণ লাগলো

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  3. কি বলবো? অনন্য অসাধারণ

    ReplyDelete
  4. ধন্যবাদ। ভালো লাগানোর জন্য।

    ReplyDelete
  5. আমাদের ভয় পেতে হয়।
    পাওয়া শিখতে হয়।
    ভয় পায় বলেই মানুষ সাপকে আদর করে না।

    ReplyDelete
  6. অসাধারণ লেখা দাদা। পড়ে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। কবে বন্ধ হবে এই মৃত্যুমিছিল? কবে থামবে এই ক্ষুদাতিক্ষুদ্র মারক বীজানুর ধ্বংসলীলা? প্রত্যেকটা মুহূর্ত কাটছে এক অনিশ্চিত আশঙ্কায়। সত্যিই ভয়ে আছি।....দেবাশিস ঘোষ

    ReplyDelete