ব্লগ : দেশান্তর/ ১

এ যেন হয় শেষবার 

মৌমন মিত্র । ৭ জুন, ২০২০ । নিউ জার্সি 


মার চামড়ার রং বাদামী। আমি আদৌ আমার এই আধ জীবনে কখনও কোনও মিশকালো, শ্যামবর্ণ কাউকে চুমু খেয়েছি? মনে পড়ে না। জীবনের মিথ্যে কিছু উন্নতির ওপর ভর করে ভেবে গিয়েছি, আরেকটু পথ এগোলেই চাঁদের পাহাড় দেখতে পাব। ব্যস্ত ছিলাম উন্নতির এই উন্নতি করতে। লোনের টাকায় মস্ত বাড়ি কিনেছি, দামি গাড়ি নিয়েছি, ব্র্যান্ডেড পোশাক পড়েছি, খাবার খেতে গিয়ে, আড়চোখে একটা সেলফি তুলেছি বন্ধুদের রেস্তোরাঁর ব্যাকড্রপ বোঝাতে। জানান দিয়েছি কত তারা হোটেলে আমি আমার বড়লোক হওয়া উদযাপন করি। আসলে আমি বড্ড গরিব, এতটাই যে, নিজের দারিদ্রের সঙ্গে নিজেই ওয়াকিবহাল নই।আমি হত-দরিদ্র; আমি বর্বতার হৃদপিন্ড!
নিউইয়র্কের বিস্তীর্ণ সেন্ট্রাল পার্ক অঞ্চল। সেখানে এক শ্বেতাঙ্গিনী যুবতী সকালে কুকুর নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। অডোবন বন সোসাইটির সদস্য ও পক্ষিপ্রেমিক এই পার্কে দাঁড়িয়ে পাখিদের ফিড করছিলেন। তিনি ভদ্রভাবে সেই মহিলাকে তাঁর কুকুরকে বেল্ট পরিয়ে রাখতে অনুরোধ করেছিলেন। আমেরিকায় আইনত কুকুরকে বাইরে নিয়ে গেলে বেল্ট অথবা লীশ পরিয়ে রাখতে হয়। শ্বেতাঙ্গ মহিলা সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে ফোন করে চিৎকার করে বলতে লাগলে, ‘‘এখানে পার্কে একজন আফ্রিকান-আমেরিকান রয়েছেন, আমি বিপন্ন।’’ কৃষ্ণাঙ্গ যুবক তাঁর ফোনে ঘটনাটি রেকর্ড করেন এবং এমন আচরণ বন্ধ করতে বলেন।
ভাগ্যিস! পাখিরা গায়ের রঙ বোঝে না। বুঝলেও গায়ের রঙ অনুপাতে মানুষকে তাঁরা ঘেন্না করতে শেখেনি।
বছর ছেচল্লিশের জর্জ ফ্লয়েড। পুলিশ শভিনের হাতে তাঁর নির্মম মৃত্যু, আশা করি আজ দেশ কিংবা বিদেশের কোনো মানুষের কাছে অজানা নয়। তাঁর এই মৃত্যুতে গোটা আমেরিকা আজ উত্তাল। প্রতিবাদের আগুন দাবানলের মতো ছড়াচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে, বিভিন্ন জনপদে। আজ তাঁর মৃত্যুর ন’দিন বাদে অফিসার শভিনের অপরাধ থার্ড ডিগ্রি মার্ডার থেকে সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারে পরিণত হল।সঙ্গে আরও তিনজন অফিসারকে এই ঘটনায় চার্জ করা হয়। শুক্রবার রাতে আত্মগোপন করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঠায় নিয়েছেন বাঙ্কারে। যদিও প্রেসিডেন্টের বক্তব্য সেদিন বাঙ্কার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তিনি। নিরাপত্তার জন্য নয়। টিয়ার গ্যাস, ন্যাশনাল গার্ড, এমনকী পথে কুকুর লেলিয়েও থামাতে পারছেন না প্রতিবাদের আগুন।
এই প্রতিবাদ, এই অগ্নিশিখায় পুড়ছে কী শ্বেতাঙ্গদের চেতনা? বোধহয় নয়। সমতার বিশ্বের স্বপ্ন দেখে গিয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং। আজ প্রায় তার পঞ্চাশ বছর বাদেও প্রতিবাদের ফেস্টুন, ব্যানারে সেই একই ক্ষোভ, সেই এক হিংসা, সেই এক আক্রোশ।
প্রতিবাদ তো ক্ষণস্থায়ী। তার নিজস্ব নিয়মে আরও কিছু মানুষ প্রাণও হারাবে। ‘দৈহিক দূরত্ব’ শিকেয় উঠেছে। ভাইরাস ছড়াবে আরও দ্রুত। আর ক’দিন এইভাবে চলতে থাকলে, হয়তো ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডারে পরিণত হবে শভিনের অপরাধ। কিন্তু তাতে কী আদৌ বদলাবে পৃথিবী? আমাদের ‘মরা গাঙে বান এসেছে,’ তাই ভাবতে হবে দূরদর্শী হয়ে।
(১) শ্বেতাঙ্গদের নীরবতা বর্ণবৈষম্যের একটি বিবৃতি নীরবতা : সম্মতি দেয়। এই নিরবতাকে প্রশ্রয় দেবেন না। শুধু শ্বেতাঙ্গরা নয়, আমরা নিজেদের জীবনেও বিভিন্ন জাতির বৈচিত্র্য উদযাপন করি নীরবতার মাধ্যমে। সন্তানদের সেখাই সকলেই সমান।আবার কাজের মাসিই জুতো খুলে দেবে স্কুল থেকে ফিরলে। আমাদের নিজের দেশের হিন্দুস্তান লিভার কোম্পানি, ফেয়রনেস ক্রিম এবং ব্লিচের বিশ্বে সর্বাধিক উৎপাদক। রং পরিবর্তন করতে ব্যবহার করা হয় ফেয়ারনেস ক্রিম ও ব্লিচ। রঙের পরিবর্তন? সে তো জানতাম গিরগিটির কাজ… অবশ্য এই গিরগিটি হতে মানুষই মানুষকে বাধ্য করেছে। ‘কালোর মধ্যে মেয়েটার মুখটা খুব সুন্দর,’ আপনি-আমি প্রায়ই এই কথাটি বলে থাকি না? আমরা কেউ-ই আসলে মানুষের মানুষ পরিচিতিতে বিশ্বাসী নই। তাই এই গায়ের রঙের বিচার ধীরে ধীরে সভ্যতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বৈষম্যতায় নীরব থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ছোটোদের সঙ্গে কখনও ‘রেসিয়াল টক’ করা হয়নি। এইভাবেই তৈরি হয়ে চলেছে অসংখ্য সেন্ট্রাল পার্কের শ্বেতাঙ্গিনী, সেই অ্যামি কুপার। শতকের পর শতক।
(২) কথা বলুন: আগামী প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলুন। তাদের দেখিয়েছেন জর্জ ফ্লয়েডের হত্যালীলা? দেখিয়েছেন অ্যামি কুপারের বিশ্বময় ভাইরাল ভিডিও? শ্বেতাঙ্গরা ডাইভারসিটি শেখায়, রেসিসম নয়। খেয়াল করবেন আমাদের দেশেও কিন্তু তাই। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে একটু তাই না? ব্যাখ্যা করে বলছি। দেখবেন পরিবারে উজ্জ্বলবর্ণা সন্তান জন্মালে, তাঁকে পরিবর্তীকালে বৈচিত্র্য অথবা ডাইভার্সিটি শেখানো হয়, বৈষম্যতা নয়। অপরদিকে যাঁরা কৃষ্ণবর্ণ,তাঁদের পরিবারে কিন্তু ছোট বয়েস থেকেই গায়ের রঙ নিয়ে তাঁকে বিভিন্ন পাঠ পোড়ানো হয়। তাঁদের যুঝতে শেখানো হয়। এঁদের মধ্যে যদি কোনও পরিবারে শ্যামবর্ণা কন্যা সন্তান জন্মায়, তবে তো আমার ভারতবর্ষে হয়েই গেল! সেই আলোচনা না হয় এখানে বাদই দিলাম। তাই সাহস করে সন্তানদের এই ঘটনাগুলির সঙ্গে আপাতত পরিচয় করান। দেখবেন কত প্রশ্নের মুখোমুখি তারা। দেখান কীভাবে প্রতিবাদের মবে, আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ পুলিশ বর্বরতায় নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়ে পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে প্রহার করছেন। কখনও লাঠি কখনো ঢাল নিয়ে। মাইলের পর মাইল দেওয়া হচ্ছে লোহার ফেন্সিং।
আজ আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডের স্মারক দিন। পুলিশ অফিসার শভিন, তাঁর হাঁটু দিয়ে হত্যা প্রণালি সমগ্র বিশ্বের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রতি রুপক হয়ে রইল। অ্যাল শার্পটন একটি ইমোশনাল সার্ভিসে ঘোষণা করেন। দুই পুলিশ আজও নিউ ইয়র্কের বাফেলো শহরের রাস্তায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিল এক বৃদ্ধকে। টাল সামলাতে না-পেরে কংক্রিটের রাস্তায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন বৃদ্ধ। রাস্তায় মাথা ঠুকে পরক্ষণেই দেখা গেল, গলগল করে রক্ত পড়ছে তাঁর কান থেকে।আবার পুলিশি বর্বরতা, এবার বৃদ্ধর শরীরে। মানুষ পাথর হয়ে থেকেছে বহুদিন। আমরা ধরে নিয়েছি এ-ই স্বাভাবিক।
প্রতি গেরস্ত বাড়িতেই বর্ণ বৈষম্যতা থাকে। তাঁর পরিচারিকার শরীরে, অশিক্ষার মানে, লজ্জার আভরণে। প্রতিবাদের আগুনে কখনও তা তীব্র হয়, কখনও ধামাচাপা পড়ে থাকে আমাদের অন্তঃসারশূন্য উদাসীন এই জীবনের আড়ালে।
এবার,তাঁকে গোড়া থেকে উপড়ানোর দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই। আমেরিকায় প্রতিবাদের শেষে, সাইলেন্ট হিংসা আরও বাড়বে। আজকাল, কেমন যেন স্তব্ধ চারপাশ। আমি অনুভব করি। লজ্জিত কেউ, কেউ-বা ডিনায়াল মোডে। প্রশাসনের হিংস্রতাকে প্রকাশ্যে করতালি না দিলেও, মনের গভীরে কোথাও যেন এঁদের বিদ্বেষ আরও গাঢ় হয়ে চলেছে। তাহলে এই ভগ্নপ্রায় সমাজের এত জটিলতায় জ্যোতিচিহ্ন দেবে কে?
প্যান্ডেমিক হওয়ার আগেই এই হিউম্যান ভাইরাসের প্রতিষেধক বার করব আমরা। কারণ জীবাণু-সংক্রমণের চিকিৎসা হয় না। অবলম্বন করতে হয় দৈনিক সাবধানতা। জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করতে লাগে পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট; এই হিউম্যান ভাইরাসের সঙ্গে লড়তে চাই সঠিক অগ্রগতির প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট। পার্সোনালি, প্রতি ঘরে ঘরে। বাড়িয়ে দিতে হবে শুশ্রূষার নরম স্পর্শ। মা যেমন করত...।

Post a Comment

2 Comments

  1. প্রাসঙ্গিক লেখা

    ReplyDelete
  2. আমেরিকায় চারশো বছরেও বর্ণবৈষম্যতা দূরীকরণের “প্রতিষেধক” আবিষ্কার হলনা। আজও কলকাতার কাগজে “পাত্র চাই” বিভাগে পাত্রীর বর্ণনায় লেখা থাকে “উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা”। আমাদের “স্বপ্ন দেখা”র কাছে অঙ্গীকার থেকেই গেল — এই সময়োপযোগী লেখাটি আরও একবার সে কথা মনে করিয়ে দিল।

    ReplyDelete