ফিচার

জীবনের সাইকেল

অরিজিৎ চক্রবর্তী


জীবনের ভারসাম্য আর সাইকেলের ভারসাম্য আইনস্টাইনের কাছে একই রকম, দুটোতেই গতি থাকতে হবে, নতুবা হোঁচট আর হুমড়ি খেয়ে পড়া এড়ানো যাবে না। করোনার লকডাউন সময়-পর্ব কাটিয়ে উঠতে উঠতে রাস্তায় সাইকেলের ব্যবহার বাড়ছে দেখে এসব কথাই মনে হচ্ছে!
আসলে সেই ছোটবেলাতেই সাইকেলের সঙ্গে আমাদের গতির অভিযান শুরু। বাবার লম্বা সাইকেলে আমার মতো খুদে কি পেরে ওঠে। তবু সাইকেলটাকে বাগে আনতে হবে। তাই হাফপেডেল দিয়েই ব্যালেন্সের কৌশল আয়ত্ব করে নেওয়ার চেষ্টা। বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেল দৌড়ের প্রতিযোগিতা। কত রকম ম্যারপ্যাচের কসরত। তারপর পর থেকেই সাইকেল যেন প্রতিদিনের নিত্য সঙ্গী। কিশোর বয়সের নির্ভরযোগ্য প্রেমযান। সাইকেল না থাকলে আমার তো প্রেমের হাতেখড়িই হত না।
ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডির স্ত্রী এমা পঞ্চান্ন বছর বয়সে সাইকেল চালাতে শিখলেন। তার চেয়ে এক বছরের বড় টমাসকে চেপে ধরলেন তাকেও  শিখতে হবে। ১৮৯৬-র জানুয়ারিতে তিনি সাইকেল চালনা শিখতে শুরু করলেন। অল্পদিনের মধ্যেই তার মনে হলো এটা ‘নেশাচ্ছন্ন’ একটি কাজ। তারপর টমাস ও এমা হার্ডি পুডল টাউন ও ডরসেটের রাস্তায় দিনের পর দিন পাশাপাশি সাইকেল চালিয়েছেন। এমা তার সবুজ রঙের সাইকেলটির নাম দিয়েছেন গ্রাসহোপার মানে ফড়িং। সাইকেলের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি সবুজ ভেলভেটের পোশাক পরে রাস্তায় নামতেন। আর টমাস হার্ডি পরতেন স্পোর্টসম্যানের পোশাক। আর্থার কোনান ডয়েল ও তার স্ত্রী লন্ডনের রাস্তায় সাইকেল চালাতেন। সাইকেল খ্যাতি রয়েছে ভার্জিনিয়া উলফের। এইচ জি ওয়েলস সারে হিলসের আশপাশে ঘুরে বেড়াতেন। আত্মজীবনীতেও তিনি সাইকেলপ্রীতির কথা লিখেছেন। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে উইলিয়াম মরিস সাইকেলে ঘুরে ঘুরে লিফলেট বিতরণ করতেন। একসময় সাইকেল হয়ে উঠল সমাজতন্ত্রের প্রতীক ও সমাজতন্ত্রীদের বাহন।
সাইকেলের স্বর্ণযুগ উঠে এসেছে সমারসেট মমের উপন্যাস ‘কেকস অ্যান্ড এল’, জেরোমকে জেরোমের ‘থ্রি ম্যান অন দ্য বুমেল’ ও এইচজি ওয়েলসের ‘দ্য হুইলস অব চান্স’-এ। প্রবল সাইকেলভক্ত ছিলেন জ্য পল সার্ত্র। তাঁর কাছে হাঁটাহাঁটির ব্যাপারটি একঘেয়েমিতে ভরা। সাইকেল চালানো অনেক ভালো। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্যারিসের রাস্তার কেবল সাইকেল চালাতেনই না, ট্র্যাক রেসিংয়ে অংশগ্রহণ করতেন। হেনরি মিলার বলেছেন, সাইকেলের চাকার চেয়ে বড় বন্ধু আর নেই। তিনি যখন সাইকেল পেলেন, খুব দ্রুত বন্ধুদের প্রতি আগ্রহ হারাতে শুরু করলেন। চাকাই হয়ে উঠল তার একমাত্র বন্ধু। ১৮৯৬ সালে আর্থার কোনান ডয়েল লিখলেন, ‘যখন মনোবল নেমে গেছে, দিনটা মনে হয় আঁধার। কাজ ভীষণ একঘেয়ে লাগে, আশা আদৌ আছে বলে মনে হয় না, তখনই বাইসাইকেলে চেপে বসো, কোনো কিছু চিন্তা না করে রাস্তায় কয়েক চক্কর লাগাও—শুধু সাইকেল চড়ার জন্যই।’
ব্যক্তিগতভাবে সাইকেল আমার কাছেও মনখারাপের সঙ্গী। কোন এক বিষণ্ন বিকেলে যখন মনভারাক্রান্ত, তখন সাইকেল আমার একলা চলোর অক্সিজেন। মনের সচেতন বা অবচেতনের প্রতিবাদ। একদিন দিয়ে আমি ভাগ্যবান, আমার এই চিরপ্রণয়ী আমাকে কখনও ত্যাগ করে যায়নি।নিগূঢ়তম অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যেতে যেতেও সাইকেলের সিটে উঠে বসে প্যাডেলে পা রাখতেই খুঁজে পেয়েছি প্রণয়ের উত্তাপ।
নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী উইলিয়াম গোল্ডিং জীবনের সফরটাকে সাইকেল আরোহণ মনে করেছেন। ‘মানুষের জীবনের যাত্রাটি বাইসাইকেলে চড়ার মতোই। আমরা জানি মানুষ সাইকেলে চড়ে চলতে শুরু করে। কোনো এক সময় মানুষ থামে এবং সাইকেল থেকে নেমে যায়। আমরা জানি সে যদি চলা থামিয়ে দেয়, সাইকেল থেকে না নামে, তাকে পড়ে যেতেই হবে।’ বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপোলা লিখেছেন, ‘আমার বয়স যখন ১৩ বছর, আমি ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে কাজ করতাম। সেখানে টেলিগ্রাম আসত, আমি আঠা দিয়ে টেলিগ্রাম কাগজের ওপর সেঁটে সঠিক ঠিকানায় বিতরণের জন্য আমার বাইসাইকেল নিয়ে ছুটতাম।'
বাইসাইকেল বহু মানুষের সম্মিলিত উদ্ভাবন। প্রথম বাইসাইকেল তৈরি করেন জার্মান প্রকৌশলী ব্যারন কার্ল ফন ড্রেইজ তার নির্মিত সাইকেলটি ছিল কাঠের। পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে এটি চালাতে হতো। পেডালচালিত সাইকেল প্রথম উদ্ভাবন করেন ফ্রান্সের পিয়ের মিশু এবং পিয়ের লামেন্ট। তবে সেখানে পেডাল সামনের চাকার সাথে লাগানো ছিল। পেছনের চাকাচালিত বাইসাইকেল প্রথম উদ্ভাবন করেন স্কটিশ প্রকৌশলী টমাস ম্যাককল। পরিবেশগত দিক থেকে বাইসাইকেল খুব কার্যকর একটি বাহন। এটি পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। চালক পেডালে যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করেন, তার ৯৫ ভাগ শক্তিই চাকায় স্থানান্তরিত হয়, অর্থাৎ ক্ষয় খুব সামান্য।
রাষ্ট্রপুঞ্জ ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল তাদের সাধারণ সভাতে সিদ্ধান্ত নেন ৩ জুন বিশ্ব সাইকেল দিবস পালিত হবে। শান্তি, সহনশীলতা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, জলবায়ু ইত্যাদি ‘ভালো যাহা দুনিয়ার’ তা দিয়ে এই সাইকেল দিবসের তাৎপর্য খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যাও করেন তাঁরা। রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্ব সাইকেল দিবস সাইকেলকে দাঁড় করিয়েছে ভবিষ্যতের ভাল পৃথিবীর আশাবাদের প্রতীক হিসেবে।
নিয়মিত সাইকেল চালালে ওজন কমে।সাইকেল চালালে ক্যালোরি খরচ বৃদ্ধি পায় এবং মেটাবলিজম বা বিপাকের হার বৃদ্ধি করে, যার ফলে ওজন কমতে সাহায্য করে। সাইকেল চালালে হাইপারটেনশনের রোগীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত সাইকেল চালালে এইচ ডি এল  বা ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে এল ডি এল  বা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। মাংসপেশির গঠনে চমৎকার কাজ করে সাইক্লিং। বিশেষ করে শরীরের নীচের অংশের গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে সাইক্লিং।মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় সাইকেল চালানো। ডিপ্রেশন, স্ট্রেস ও অ্যাংজাইটি কমায় নিয়মিত সাইক্লিং।
সুতরাং দূষণহীন দ্বিচক্রযানটির অবধারিত সখ্য অনস্বীকার্য। তাই আজ বিশ্ব সাইকেল দিবসে আমাদের আধুনিক জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকুক এই দ্বিচক্রযানটির ধাবমানতার স্বরলিপি।

Post a Comment

2 Comments

  1. চমৎকার!
    একটি উপযোগী গদ্য।
    ধন্যবাদ।

    ReplyDelete