গানের পাখি : তোমাদের এই হেমন্ত/ ২


তোমাদের এই হেমন্ত/ ২

আবীর মুখোপাধ্যায়


সেই শুরু— ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’— গানই হয়ে উঠল দুই শিল্পীর সখ্য-সেতু!
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সলিল চৌধুরী জুটি একে একে উপহার দিল বহু গান। সেই পঞ্চাশ সালেই, সলিল তখনও আণ্ডারগ্রাউন্ডে, হেমন্ত রেকর্ড করলেন তাঁর সুরে ‘রানার’ গানটি। হেমন্ত তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন, ‘‘তখন সলিলের সুরে বেশ কয়েকটা গান রেকর্ড করলাম। সুকান্তর ‘অবাক পৃথিবী’ শুনে শ্রোতারা মুগ্ধ হল। এই এক প্রতিভাবান কবি সুকান্ত। বড় কম সময়ের জন্যে এসেছিল পৃথিবীতে। তাই তাকে খুব অল্প বয়সেই নামতে হয়েছিল কাজে। এই বয়সেই কবিতায় হাত দিয়ে করেছিল এক অপূর্ব সৃষ্টি। তার সেই কবিতা সলিল চৌধুরীর মতো দক্ষ সুরকারের হাতে পড়ে সুরের পরশ পেলো। হয়ে উঠল প্রাণবন্ত। সুকান্তর ‘রাণার’ এতদিন বই-এর পাতায় ছুটছিল। এবার সুর পেয়ে আমার গলায় চড়ে ছুটতে লাগল। ‘রাণার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে, রাণার ছুটেছে খবরের বোঝা হাতে’। এই গানটা গাইতে গাইতে আমার মনে হত আমিও যেন রাণার-এর মতো ছুটে চলেছি। অবশ্য গানের বাজারে। তখন আমিও ছুটছি আমার গানও ছুটছে। অনেকেই এসে ধরছে তাদের সুরে গান করবার জন্যে।’’
সে সময় একজন শিল্পী, অন্য একজন শিল্পীকে সম্মান করতেন। হেমন্তের স্মৃতিকথনের পাশাপাশি আমরা পড়ব সলিল চৌধুরীর স্মরণ— ‘‘কতই বা তখন বয়স হবে আমার? বড়জোড় কুড়ি একুশ! কিন্তু দেখতে ছোটখাটো ছিলাম বলে, মনে হতো বয়স আমার আরও কম। কেউ বিশ্বাসই করতে চাইতো না, হেমন্তদার গাওয়া ওই গানটার গীতিকার এবং সুরকার আমিই। আমি সেই সলিল চৌধুরী।... সেই সময় একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। আমরা, মানে হেমন্তদা, সুচিত্রা মিত্র এবং আমি আই.পি.টি-এ-র হয়ে গান গাইতে গিয়েছি গৌহাটিতে। একটা ফাংশানে সেদিন উপস্থিত ছিলেন গৌহাটির কটন কলেজের প্রিন্সিপাল। আমিই সেই সলিল চৌধুরী, যে লিখেছে হেমন্ত মুখার্জির গাওয়া আলোড়ন-সৃষ্টিকারী ওই গানটি এবং তার সুরও রচনা করেছি আমি-ই— আমাকে দেখে প্রিন্সিপাল তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি, আমিই সত্যিকারের গীতিকার এবং সুরকার। আমার সম্বন্ধে বিশদ পরিচয় পেশ করে হেমন্তদাই সেদিন সেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে আমায় রক্ষা করেছিলেন।’’
‘রাণার’— গানটি রেকর্ড যখন হল, অর্কেস্ট্রেশনও করেছিলেন হেমন্ত নিজেই। সলিল মতামত দিয়েছিলেন। আর গানের শুরুতে ভূমিকাটুকু করে দিয়েছিলেন। রেকর্ড বের হলে আবার চারদিকে সোরগোল! এভাবেই বাজারে এল ‘অবাক পৃথিবী’ গানটিও।
সে গানের গল্প অবশ্য একটু অন্যরকম। প্রথম দিকে সলিল চৌধুরী সুর করার পর গানটি গাইতেন জর্জ বিশ্বাস এবং প্রীতি সরকার।
একদিন তুমুল গান-গল্পের আসর বসেছে রাসবিহারী মোড়ের কাছে জর্জের বাড়িতে। সবাই পার্টির লোক। তখনও দেশপ্রিয় পার্কের পাশ দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির মিছিল যাচ্ছে। গঙ্গার হাওয়ায় উড়ছে লাল পতাকা। শ্লোগান ভাসছে— ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়, ভুলো মৎ... ভুলো মৎ।’
কখনও সখনও জর্জ তাঁর মোটর সাইকেল থামিয়ে গলা মেলান, ‘ভুলো মৎ... ভুলো মৎ।’
তো সেই জর্জের ঘরে, সেখানেই প্রথম গানটি শুনলেন হেমন্ত। জর্জ হেমন্তকে বললেন, ‘‘হেমন্ত তুমিই এই গানটা রেকর্ড করো।’’
হেমন্ত অবাক হলেন! ঘরের মধ্যে সকলেই চুপচাপ। জর্জ তাঁর চিরচেনা ভঙ্গিতে হারমোনিয়ম টেনে ‘অবাক পৃথিবী’র সুর বাজাতে বাজাতে হেমন্তকে বললেন, ‘‘তুমিই এই গানটা রেকর্ড করো। জানো তো, আমাকে ওরা গাইতে দেবে না!’’
সকলেই জর্জের সঙ্গে রেকর্ড কোম্পানির সে সময়ের সম্পর্কের কথা জানত। সকলেই চুপ। হেমন্ত সেদিনই গানটা তুলে নিলেন। আবারও সংযোজন হল বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাসে নতুন একটি গান! এখনও এ গানটি কান পেতে শুনি আমরা।
এরপর দুটি বছর হেমন্ত-সলিল জুটির যোগাযোগ কিছুটা কমে যায়।
হেমন্ত সে সময় বোম্বে চলে গেছেন। ফের নতুন করে দু’জনের যোগাযোগ হল, সলিল চৌধুরী যখন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ‘পাল্কীর গান’ সুর করলেন। প্রায় তিনমাস ধরে সুর করলেন। সুরকার লিখছেন, ‘‘সেই সময় আমার বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুসংবাদ শুনে শুধু সমবেদনা নয়, হেমন্তদা আমাকে তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করার একটা অফারও দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি তখন বাংলা ছবি নিয়ে কলকাতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। হেমন্তদার ডাকে আর বোম্বাই যেতে পারলাম না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সেই সময় আমার সুরে ‘পরিবর্তন’, ‘পাশের বাড়ি’, এবং ‘বরযাত্রী’ ছবির গান অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। অনেক বাংলা ছবির অফার তখন আমার হাতে। কিন্তু, এই সময়েই, হেমন্তদা একবার কলকাতায় এসেই আমার খোঁজ করলেন। ‘পাল্কীর গান’-এর সুরটা তখন করেই রেখেছিলাম। গানটা হেমন্তদাকে শোনালাম। এই গানের একটা ‘ধুন’ হিসেবে ‘হুনহুননা’ যোগ করলাম। হেমন্তদা গানটা শুনে বেজায় খুশি। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন রেকর্ড করবার জন্য।’’
১৯৫২ সালেই ‘পাল্কীর গান’ রেকর্ড হল। সলিল চৌধুরীর সুরে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সেই গান আধুনিক কাব্যসংগীতের ক্ষেত্রে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিল। গ্রামাফোন কোম্পানির পি. কে. সেনের উৎসাহে এই রেকর্ড বাজারে আসার পর বিপুল জনপ্রিয় হয়। সলিল লিখছেন, ‘‘এটা ঘটেছিল, তার একমাত্র কারণ, হেমন্তদার মতো কণ্ঠ ছিল বলেই। হেমন্তদার একটা বিশেষ গুণ ছিল, যা অন্য কারো মধ্যে খুব কমই দেখা যায় সেটা হচ্ছে নতুন কিছুকে গ্রহণ করার ক্ষমতা, তাকে উপলব্ধি করার মতো বোধ। মানে, কোন পরীক্ষামূলক ব্যাপারকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করার সাহস হেমন্তদার ছিল। তাই ‘পাল্কীর গানটা শুনেই তিনি লাফিয়ে উঠেছিলেন। নতুন ধরনের একটা এক্সপেরিমেন্ট’ কী হবে, না হবে, সেই ঝুঁকি নিয়েও তিনি নতুনকে গ্রহণ করতেন। এ ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল।’’
দুই শিল্পীর আবার দেখা হল, পরের বছরই। যখন পরিচালক বিমল রায়ের ডাকে ‘দো বিঘা জমিন’-এর চিত্রনাট্য নিয়ে বোম্বে গেলেন সলিল। প্রথম ছবিতে মান্না দে, রফি এবং লতা মঙ্গেশকর গাইলেন। সংগীত পরিচালক হিসেব তাঁর পরের ছবি বিমল রায়ের ‘বিরাজ বহু’-তে চারটে গানই গাইলেন হেমন্তকুমার।


এরপর পুজোর গান। তখন পুজোর গান মানে বাঙালির কাছে উজ্জীবনের গান।
১৯৫৪-৫৫-তে হেমন্ত দুটি গান রেকর্ড করলেন সলিলের সঙ্গে— ‘পথে এবার নামো সাথী’ এবং ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’। পর পর এল গান। আর সেই দেখেই দু’জনের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দিলেন ইন্ডাস্ট্রির দু’একজন। হেমন্তর কাছে বলতে লাগলেন, ‘‘সলিল চৌধুরী বলে বেড়াচ্ছে—তার সুরে গান না গাইলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারতেন না।’’ তারাই আবার সলিলকে বললেন, ‘‘হেমন্তদা নাকি বলে বেড়াচ্ছেন—আমি যদি না গাইতাম, কে সলিল চৌধুরীকে চিনত?’’ চিড় ধরল সম্পর্কে! ভু‌ল বোঝাবুঝির ফলে থেমে গেল জনপ্রিয় জুটির সুরের যাত্রাপথ! কয়েক বছর পর দু’জনে মুখোমুখি হলেন। অভিমানে সলিল সরাসরি বললেন,
‘‘হেমন্তদা, আপনি নাকি বলে বেড়াচ্ছেন, সলিল চৌধুরী কে? হেমন্ত মুখার্জি যদি না থাকত কে ওকে চিনত?’’
হেমন্তর মুখ থমথম করছে। সলিলকে বললেন, ‘‘কী সব বাজে কথা বলছ? আমি তো শুনছি, তুমিই নাকি বলে বেড়াচ্ছ—কে হেমন্ত...!’’
সত্যের জয় হল আবারও। মান-অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে ফের সুরের হাওয়ায় সওয়ার হলেন জুটি। হেমন্ত রেকর্ড করলেন, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ এবং ‘শোন, কোন একদিন’। এই দ্বিতীয় গানটি এখনও— এই প্রজন্মের কাছেও দারুণ জনপ্রিয়। কথা ও সুরের আবেশে বাংলা গানের এমন আয়োজন খুব বেশি নেই। এ পর সুকান্তর ‘ঠিকানা’ গানটির কথা বলতে হয়। ১৯৭০ সালে সলিল বোম্বেতে রেকর্ড করেন গানটি। ছায়াছবিতেও দু’জনের কাজ চলছিল। সলিল তাঁর সংগীত পরিচালনায় দুটি বাংলা ছবি— ‘রায় বাহাদুর’ ও ‘লাল পাথর’-এ হেমন্তকে দিয়ে গান করালেন। দীর্ঘ সময় পরে উল্লেখযোগ্য কাজ বলতে ১৯৮০-তে। খুব জনপ্রিয় না হলেও, ‘অনেক গানের পাখি’ শীর্ষক লং-প্লেয়িং রেকর্ডটি সলিলের কাছে ‘অসাধারণ কাজ’। সেই পর্বেই হেমন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন! দূরের পথে যেতে যেতে, গেয়ে যান সলিলের জন্য ‘হারানের নাত জামাই’ ছবির ধানকাটার গান— ‘আয়রে ও আয়রে’। হেমন্তর এ গানে কোন সূদুরে যে হারিয়ে যাই— ঠিক ছায়াছবির মতোই, নিজেদের অজান্তেই সমবেত ভিড়ের সঙ্গে গলা মেলাই— ‘‘এই মাটিতে কলিজার আশা,/ স্বপ্নের বীজ বুনি,/ আর চোখেরই জল সেচ দিয়ে/ ফসলের কাল গুনি/ ক্ষেতের আলে আলে/ আজ সোনারই ঢেউ খেলে/ আহা মাটি মাতা/ দুই হাতে অন্ন ঢালে/ এই ঘরে ঘরে নবান্নেরই হবে কি রোশনাই...।’’

(ক্রমশ)




Post a Comment

0 Comments