ব্লগ : চিত্ররূপময়/ ১

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর অপূরণীয় ‘দূরত্ব’ 

সুমন গুণ 


জীবনানন্দের আট বছর আগের একদিন বা রাত্রি কবিতা নিয়ে ফিল্মের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একবার। কিন্তু, আক্ষেপ করেছিলেন তিনি, সমস্যা হচ্ছে এ ধরনের ছবির এদেশে চল নেই। কে দেখবে? এই প্রশ্নটি যদি সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচিত হত বুদ্ধদেব তাহলে আর ছবি তৈরি করতেন না নিশ্চয়ই। রাত্রি বা আট বছর আগের একদিন নিয়ে হয়তো করতে পারেননি, কিন্তু নিম অন্নপূর্ণা নিয়ে করেছেন। এখনও পর্যন্ত বুদ্ধদেবের যে ছবি তিনটির সঙ্গে কবিতা ওতপ্রোত বলে মনে হয়েছে আমার, সেগুলি হল—‘দূরত্ব’, ‘চরাচর’, ‘নিম অন্নপূর্ণা’।
‘দূরত্ব’ ছবিটি, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের শেষ হয়েছিল এমন অসমাপ্ত অথচ সম্ভাবনাময় ভাষ্যে: ‘আজও মেঘ করেছে। কালো হয়ে এসেছে আকাশ। হয়তো বৃষ্টি আসবে’। হয়তো শব্দের অপূরণীয় দ্বিধা না থাকলে গোটা কথার মানে পালটে যেত প্রায় পুরোটাই। সোজাসুজি কোনো সমাপ্তির, সূচনারও, ফ্রেম বুনে নিতে পারতেন দর্শক।
তা যে হল না, তার দুর্মুল্য দুটি কারণ টের পেলেই ধরা যাবে বুদ্ধদেবের ছবির মেজাজ। বোঝা যাবে, যে-সর্বস্ব অনিশ্চয়তা সদ্যতম শিল্পকলার, কবিতারও বিশ্বপ্রকরণ, বুদ্ধদেবের ছবির সঙ্গে তার সম্পর্কও।
প্রথম কারণটি ‘দূরত্ব’ ছবির ঘটনাক্রমেই নির্দিষ্ট। সমস্যা ও সম্ভাবনার মধ্যে যে স্বয়ংক্রিয় ব্যবধান, এ-ছবি তারই কয়েকটি গমক ছুঁয়ে ছুঁয়ে তৈরি। ফলে, কোনো মান্য নির্ণয়, কোনো পর্যায়েই, পাওয়া যাবে না এ-ছবিতে। দেখা হবে না কোনো সম্পর্কেরই স্পষ্ট একমাত্রিক, কোনো ঘটনা, সিদ্ধান্ত ও সমাধানের ছক বুঝে এগোবে না কিছুতেই।
তাই, গোটা ছবিটিই তৈরি হয়, দুটি-একটি চরিত্রের ব্যতিক্রমে, অনুচ্চ ও অসমাপ্ত সংলাপে। সবসময় ঠিক সংলাপেও নয়। আধো কথা, অন্যমনস্ক সিগারেট, দিকচিহ্নহীন দৃষ্টি, অসচেতন দাঁড়িয়ে থাকা এবং এরকমই নানা বিভঙ্গে দূরত্ব বেড়ে ওঠে। ছবির শুরুতেই বিজ্ঞাপন কৌশলে কলকাতার তিলোত্তমাকল্লোল, তারপর আগে-পরে বৃক্ষবিলাস, স্তব্ধযান, অঞ্জলির তিনবার মুহুর্মুহু দৃষ্টিপাত, ধূসর মন্দার। খেয়াল হয়, অঞ্জলির ললাটে একটি আমন্ত্রণময় টিপ, কিন্তু দৃষ্টির দ্বিধায় তা আপতত রাগলুপ্ত। মন্দার ও অঞ্জলির এই সংঘর্ষে আরো লক্ষ্য হয়, পাশে একটি অভাবনীয় গাছ এবং নিঃসম্পর্ক রিকশা। অঞ্জলির আগে-পরে, অথবা তার সঙ্গেও হতে পারত, দুজন সুবেশিনী।
এমন যে-সময়, যে সময়ে সব সম্পর্কই দ্বিধার্ত, কোনো পরিচ্ছন্ন বিন্যাস সেখানে গড়ে উঠতেই পারে না। লিফটে বিরক্ত সহযাত্রীর সঙ্গে মন্দারের মুহূর্তেও একই আঁচ। সহমর্মিতার দুটি দরজাই শূন্য। আপাতত শান্তিকল্যাণ শুধু নতুন সঙ্গিনীর লাস্য, ভাবনাহীন রগড়। অবস্থানের বাইরে আরেক রাস্তা, মিছিল, মন্দারের বিয়ের প্রশ্নে আবার স্বশাসিত দ্বিধা ও ধৈর্যহীনতা।


এই মন্দারের তো অন্য জীবনও ছিল। ছিল বলেই তো সে প্রসঙ্গ। রাজনীতির দিনে পরপর মানুষ কাটিয়ে সে ছুটে যায়, বিপ্লবের লক্ষ্যে বা বিপরীতে। খাঁচার পাখিকে দানা ছড়াবার দৃশ্যটি, মন্দারের এই সময়ের নিরিখেই অর্থময়।
ছবিতে জটিলতার আর একটি মাত্রা খুলে গেছে মন্দারকে অঞ্জলির এই প্রশ্নে : ‘সবাই বুঝতে পারে এমন সহজ কথা বলতে পারেন না’? একেবারে এই প্রশ্নই প্রায়, মনে পড়ছে, ‘ফেরা’য় সেই প্রজন্মবালক করেছিল তার আর্দ্র অভিভাবকে। সেখানেও এই আবৃত দুর্বোধ্যতার শিয়রে ছিল স্বপ্নের প্রায়-নিভে-আসা আগুন। মন্দারও, যে-মন্দার অঞ্জলির এই অবুঝ প্রশ্নের সামনে দাঁড়ানো, আসন্ন উৎসবের দিকে তাকিয়ে। অঞ্জলির সঙ্গে তার সম্পর্কও, যা ক্রমশ ব্যাহত অতীত হয়ে উঠবে, তার রাজনীতিলগ্নতার সমার্থক। এই পর্বে তারা ব্যস্ত ও বিপর্যস্ত পথ পার হয়ে যায় একসঙ্গে, হাঁটে নদীর পাশ দিয়ে, কারুকাজময় অথচ বন্ধুর রেলিংঙে অবুঝ হাত রাখে অঞ্জলি, সশব্দে গন্তব্যমর্মে ছেড়ে যায় জাহাজ। পর্দায় অঞ্জলির ভরা ও নিবেদিত শরীর, অলঙ্কৃত মুখ।
এই পর্ব ভেঙে যায়। কেন যায়, তার সরাসরি কারণ তো একটা আছেই, কিন্তু কখনোই যেন পুরো ফ্রেম, চারকোণা, গড়ে তুলতে চান না পরিচালক। তাঁর কবিমন তাঁকে নিয়ন্ত্রিত করে এখানে। মন্দার পীড়িত হয়েছে অঞ্জলির সন্তানসংসারে, অঞ্জলি ফিরেও যায় সমস্ত সংসার ঘিরে, হাতে নিজস্ব বাক্স। এমনকি মন্দারের সঙ্গে বিবাহপূর্বের উদ্দেশ্যও, পরিষ্কার জানিয়েছে সে : ছেলেটির পরিচয় দরকার ছিল। কিন্তু, প্রত্যুত্তরে, ব্যাগ্র ও বিচলিত মন্দার : ‘শুধু তাই’? আবার বিদীর্ণ অঞ্জলি : ‘যদি বলি তোমাকেও চেয়েছি, বিশ্বাস করবে’?
এই যে আমর্ম দ্বৈত, যা নির্দ্বির্ধায় উচ্চারণ পায় না, অঞ্জলির এই প্রশ্নে আর মন্দারের নিরুত্তর নিরুচ্চারণে বা আন্দোলিত, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রথম ছবিতেই তার প্রতিষ্ঠা এতটাই অবারণ। কবি বুদ্ধদেবের সঙ্গে পরিচালক বুদ্ধদেবের সখ্য তৈরি হল এখানে। মন্দার ক্লাসে নারীমুক্তিপ্রবণ, কিন্তু এমনকি তা তাত্ত্বিক ও তাৎক্ষণিক আবেগও পায় না, নির্বিচার রোল-কলের মতোই যেন তা। একইরকম তুচ্ছ স্বাভাবিকতায় আক্রান্ত চারপাশের সবকিছু, বাসে, রেস্তোরাঁয়, জনস্রোতে ঘটনার নির্বিকার বিন্যাস।


ঘন ও আপ্রাণ এক  আর্তি, তবুও, বৃষ্টিবিন্যাসে, মন্দারের নিঃশব্দ দূরভাষণে, নন্দিনীর কাছ থেকে ফিরে অঞ্জলির দরজায় এসে দাঁড়ানোয় ফুটে ফুটে ওঠে। কিন্তু গোটা আয়োজনের মধ্যে কোথাও ধ্রুব আশ্বাস নেই, নেই নিশ্চিত পরিণতির ধ্বনি।
শুধু, শেষের ঐ অন্তরালভাষ্য ছাড়া। হয়তো বলায় যে-দ্বিধা, তা সংশয় নয়, সঞ্চার। আগুনের দিকে, আমন্ত্রণের দিকে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিতে এমন সজ্জিত অথচ গোপন রহস্যলিপি সাজানো থাকে অবিরল। কখনোই উচ্চকিত নয়। ‘দূরত্ব’ ছবির শেষে উচ্ছ্রিত বৃষ্টির স্বর বুদ্ধদেবেরই একান্ত ধরন।

Post a Comment

1 Comments

  1. আশ্চর্য সুন্দর উপলব্ধির চিত্ররূপময় প্রকাশ,,,,এ আপনার
    কলমেই সম্ভব,,,

    ReplyDelete