‘শহীদের ডাকে’ গাইতেন কলিম

গানের পাখি/ ৬

আবীর মুখোপাধ্যায়

স্বর্ণযুগের বাংলা গানের সুর ও কথার মতোই মিঠে সেই সব গান তৈরির গল্পও। সুরকার, গীতিকারদের সঙ্গে শিল্পীদের সম্পর্ক— জন্ম দিয়েছে যামিনি পটে জড়ানো বিচিত্র উপাখ্যানের। এই ধারাবাহিকে আমরা ফিরে ফিরে শুনব হারানো দিনের মনকেমনের গান। চেয়ে চেয়ে অপলক দেখব সুরের আকাশে শুকতারা। আর একলা হয়ে নিবেদন করব একে অপরকে গানের রেকাব।


ই কদিন পিলু ও বারোয়াঁয় কলিমের কণ্ঠে— ‘‘এসেছে নিবিড় নিশি, পথরেখা গেছে মিশি— সাড়া দাও, সাড়া দাও আঁধারের ঘোরে’’— শুনতে শুনতে ‘ভরা থাক স্মৃতি সুধায়’ অ্যালবাম খুলে ইউটিউবে একে একে শুনি— ‘কান্নাহাসির-দোল-দোলানো’, ‘আমায় থাকতে দে-না’, ‘বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি’, ‘দিন পরে যায় দিন।’ সব গানেই আশ্চর্য ভাব-সমাবেশ। দীপ্ত-উদাত্ত কন্ঠ, নিটোল উচ্চারণ, অনুভবের আবেদন কলিমের গায়কীতে ‘কান্নাহাসির-দোল-দোলানো’ শ্রোতাদের মহান প্রাপ্তি। কবির ৫৫ বছর বয়সে লেখা পূজা পর্যায়ের গানটির স্বরলিপি করেছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কালাংড়া রাগ-ছায়ায় এ গানের সঞ্চারী  ‘রাতের বাসা হয়নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি,/ বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি’— র পর কলিম যখন আভোগে গাইছেন ‘শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন-মাঝে’— মর্মসুর ছড়িয়ে পড়ছে যেন চরাচরে। ‘কোথায়’ কথাটির বহুস্তর মীড় এসে যেন গড়িয়ে থামে দুটি শব্দ পরে ‘হায়’ উচ্চারণে!
এমন দহন, এমন দীপ্তি কলিমের প্রায় সব গানেই। খুব প্রিয় আরেকটি গানে এসে থামি। ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’। গানটি রবীন্দ্রনাথ ৪১ বছর বয়সে লিখেছিলেন। এটিরও স্বরলিপিকার দিনুঠাকুর। রাগ নির্দেশ পাওয়া যায় যোগিয়া। কিন্তু বহুরাগ মিলেমিশে গেছে এর সুরের গহনে। শৈলজারঞ্জন মজুমদার বলছেন— ‘‘রাগমিশ্রণের উদাহরণস্বরূপ প্রথমেই একটি বিশেষ গানের উল্লেখ করা যায়— ‘‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু।’’ এই গানটিতে প্রধানতঃ বিভাস ও ললিত রাগের মিশ্রণ ঘটলেও গানটির সম্পূর্ণ অবয়ব খুঁটিয়ে দেখলে ধরা পড়বে যে এতে আরো দুটি রাগ— রামকেলি ও আশাবরীরও ছায়া পড়েছে। কিন্তু এই গানটি গাওয়ার কালে এতগুলি রাগ যে স্বল্পপরিসর গানটির সুরে আত্মগোপন করে আছে তা একেবারেই মনে আসে না। বরং মনে হয়, এর অন্তর্নিহিত ভাবপ্রকাশের রূপ এই হওয়া উচিত, এর চেয়ে উৎকৃষ্টতর আর কিছু হতে পারে না।’’
এই গানটিই কবির-কণ্ঠে শেষ শয্যায় শুনতে চেয়েছিলেন তাতাবাবু। পার্থ বসু ‘গায়ক রবীন্দ্রনাথ’ এ জানাচ্ছেন, ‘‘১৯২৩ সালে মৃত্যুপথযাত্রী সুকুমার রায়কে কবি শেষবারের মতো দেখে এসে বলেছিলেন, ‘পূর্ণস্বরূপের বিশ্বে আমরা ফাঁক মানতে পারব না। এই কথাটি আজ এত জোরের সঙ্গে আমার মনে বেজে উঠেছে তার কারণ সেদিন সেই যুবকের মৃত্যু শয্যায় দেখলুম সুদীর্ঘকাল দুঃখভোগের পরে জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর মত অত বড় বিচ্ছেদকে, প্রাণ যাকে পরম শত্রু বলে জানে, তাকেও তিনি পরিপূর্ণ করে দেখতে পেয়েচেন। তাই আমাকে গাইতে অনুরোধ করেছিলেন— আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু...। যে গানটি তিনি আমাকে দু’বার অনুরোধ করে শুনলেন সেটি এই: দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো।’’’
কলিমের এ গানের গায়নে আছে আশাবরী, ললিত, রামকেলি ও বিভাস— মুখ্যত এই চারটি রাগসুরের সমন্বয়। এত নিবিড় রাগছায়া, কখনও কোনও একটিকে আলাদা করা যায় না। কলিমের কণ্ঠে এই রাগ-সংগীতের দখল নিয়ে স্মৃতি পাই খালেদ চৌধুরীর লেখায়। খালেদ লিখছেন— ‘‘সাতচল্লিশে ‘শহীদের ডাক’ নিয়ে আমরা গেলাম আসাম-বাংলা সফরে। সেই দলে কলিমও ছিল। ওখানে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ওখানে এক হিন্দু বাড়িতে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তাদের কাছে আমাদের পরিচয় দেওয়া হয়েছিল কালী চৌধুরী আর কল্যাণ মিত্র। তা খেতে বসে শুনতে পাচ্ছি যে তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের বাপবাপান্ত করছে। ওদিকে যখন শো হচ্ছে তখন কিন্তু খালেদ চৌধুরী আর কলিম শরাফী নামেই পরিচয় করানো হত। একদিন আমি ও কলিম revolt করলাম। বললাম, প্রয়োজনে আমরা বিস্কুট খেয়ে থাকব, তবু ওইভাবে ধাপ্পা দেওয়ার দরকার নেই। তার চেয়ে বরং প্রকৃত নামটা বলব। তাতে কারোও বাড়িতে ব্যবস্থা হলে হবে। তিন মাস ওইভাবে সফর করলাম। সেখানে কলিম মূলত গাইয়ে হিসেবেই ছিল। অনেকগুলো গান ওই লিড করত। ‘শহীদের ডাক’-এ ও ভয়েস দিত। কয়েকটা জায়গা ছিল বেশ দুঃখের... আমার ঠিক হুবহু মনে নেই, সেখানে আশাবরীতে একটা আলাপ ছিল। কলিম খুব সুন্দরভাবে সেটা করত। আমি পেছন থেকে বাজাতাম। খুব থমথমে একটা আবহাওয়া.. তা আশাবরীতে আলাপটা হত এটা আমার স্পষ্ট মনে আছে।’’
কলিমের এই গানেও দুঃখ-স্পর্শ। ব্যথ্যার মীড় ছুঁয়ে দেয় হৃদয়ের কোমল স্বরগুলি। ‘বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/ তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে’— ফিরে ফিরে শুনি। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’ গানটি নিয়ে লিখছেন, ‘‘একটিকে যেই ধরে ফেলেছি বলে মনে হচ্ছে, অমনি দেখি সেটি সরে গেছে, অন্যটি এসে হাজির। শুদ্ধ ‘ধা’ ও শুদ্ধ ‘নি’র আশেপাশে আনাগোনা নেই; বিভাস রূপহীন অথচ ‘সা; রে গা রে সা’ সুরগুলি রয়েছে বিভাসের প্রতিনিধি হয়ে। রামকেলিও লুকিয়ে ফুটেছে স্বর-বিন্যাসে। আবার ‘কুসুম ফুটে’ কথাগুলির সুর ললিতকে প্রকাশ করেছে। আর সব ছাপিয়ে যে সুর আপনাকে প্রকাশ করেছে সে হচ্ছে আশাবরী।’’
ঘুরে ফিরে এই গানের সঞ্চারীও আমাদের বাদল দিনের মস্ত মেঘের নীচে একলা করে দেয়। মুহুর্তে সরে যায় দালানকোঠা। ছায়ার অন্ধকারে চুরমার হয়ে যায় মিথ্যের সাজানো সংসার। মনে পড়ে স্মৃতিপাঠ— যে বছর এই গানটি কবি লিখেছিলেন, সেবারই মধ্যমা কন্যা রেণুকা হঠাৎ ক্ষয় রোগে অসুস্থ, তাঁকে হাজারিবাগ ও আলমোড়ায় নিয়ে গেলেন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় কলকাতায় তাঁকে ফেরৎ আনা হল, সেখানে ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু। ‘তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,/ কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে’—কলিমের এই গানের গায়নে, শব্দ-সুরে অশ্রু নামে!
শঙ্খ ঘোষ লিখছেন, ‘‘আমরা বুঝতে পারি কীভাবে কোন্‌পথে সান্ত্বনা এসে পৌঁছচ্ছিল সেই বৃদ্ধ অথবা তাঁর বিয়োগবিধুরা মেয়েটির মনে। বুঝতে পারি, জীবন যখন এসে দাঁড়ায় ব্যর্থতার বা অপচয়ের বা মৃত্যুর একেবারে মুখোমুখি, তাকে পেরিয়ে আসবার অনেকগুলি পথ কীভাবে রবীন্দ্রনাথ খুলে রাখেন তাঁর গানের মধ্যে, কীভাবে তৈরি হয়ে ওঠে মনে এক শুশ্রূষা।’’
দুঃখ পরিণাম নয়, যাপনের মধ্যে দিয়ে সকল ‘অন্তরগ্লানি’, ‘ক্ষয়’ পেরিয়ে আপন সত্তাকে ছুঁতে চাওয়াই পূর্ণতা। ‘‘নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ— সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।’’
ভুবনজুড়ে এই দুঃসময়ে কলিমের কণ্ঠে গান শুনতে শুনতে আবার মনে হল, রবীন্দ্রনাথের গানই আমাদের সকল অসুখের নিরাময়। বিড়ম্বিত বাঙালির এগিয়ে চলার মন্ত্র!

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments