ভাবছি টিকা এলে অসুখ সারবে


লকডাউনের দিনলিপি

ভাবছি টিকা এলে অসুখ সারবে

সুমন ঘোষ


লিন ফুটো-ফুটো নোংরা একটা লুঙ্গি। লুঙ্গির পিছনদিকে কোঁচরে গোটানো অল্পদামের মোবাইল। লুঙ্গির ওপর থেকেই অদ্ভুত কায়দায় মোবাইলে চাপ দিয়ে  ঘন-ঘন সময় জেনে নিচ্ছে সে। মোবাইলখানা তার বহুচর্চিত সুরেলা গলায় বলে দিচ্ছে, দ্য টাইম ইস...!
মুখ থেকে অনর্গল থুথু ছেটানো বাচলতা। সে আমাদের লোকাল নেতা। কক্ষনো মুখে মাস্ক পরে না। মানে পরতে হয় না আর কী! সে মনে করে করোনা স্বয়ং তাকে ভয় পায়। নানা ধান্ধায় এ-পাড়া থেকে ও-পাড়া সে শুঁকে বেড়ায়। কার অসুখ কার বিশল্যকরণী! কার শক্তি কার দুর্বলতা! সে-ই বলল, এখন নাকি ইটালিয়ান পদ্ধতিতে ব্যাঙ্ক চলছে। রেশনও তাই।
ইটালিয়ান পদ্ধতি মানে? মুখে কিছু বলিনি, কৌতুহলভরে তাকালাম।
সে বলে চলল, প্রচুর মানুষ প্রতিদিন ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে আসছে। তারা ইট পেতে রাস্তা ব্লক করে রাখছে। সবাই সবার গায়ে-গা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে। পা ধরে গেলে ইটের ওপর বসছে। কেউ কোনও নিয়ম মানছে না। সুযোগ বুঝে ব্যাঙ্কও নাকি বিচিত্র ধরণের অসততা করছে। খুব ধীর গতিতে কাজ চলছে ব্যাঙ্কে।
মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে ইট পেতে এই টাকা তোলার ব্যাপারটাই ইটালিয়ান পদ্ধতি বলছ?
সে উজ্জ্বল নেত্রে সম্মতি জানাল।
গ্রামের ভিতরে দুটি রেশনকেন্দ্র। ডিলাররা তাদের বাড়িতেই রেশনের কাজকর্ম চালায়। করোনা পরিস্থিতিতে রেশনে প্রচুর জিনিসপত্র আসছে। বিভিন্ন ধরণের কার্ডের জন্য বিভিন্ন সুবিধা। অনেক মানুষ আবার বিপুল অবস্থাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও কার্ড-কারচুপিতে বিশেষ সুবিধাভোগী। তবে সমস্ত ধরণের মানুষের জন্যই মাসে ৫ কেজি করে চাল একেবারে বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। ফলে একদম গরীবগুর্বো থেকে ঈষৎ মধ্যবিত্ত এমনকী মাসে লক্ষাধিক টাকা রোজগার করা লোকগুলোও দাঁড়িয়ে পড়ছে রেশন লাইনে। ঐ ইটালিয়ান পদ্ধতিতেই সেটা চলছে। রেশনের জন্য নানা গ্রামের লোক মাস্কের তোয়াক্কা না করে এ-ওর গায়ে চাপাচাপি করে গ্রামের ভেতরে ভিড় জমাচ্ছে। গোলদাগ বা চকখড়ি কোনও কিছুতেই তাদের রোধ করা যাচ্ছে না। নেতাটি বিরক্ত, অসহায়। এই মওকাতে সে রেশন ডিলারদের একটু কড়কে দিতে চায়। একটু বেকায়দায় ফেলতে চায়। হয়তো কোনও গোপন বখরা বাকি রয়ে গেছে। কিন্তু এখন সে তার কপট অসহায়তার কথা দাপটের সঙ্গে জানাচ্ছে।
এর মধ্যে হল কী, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ধেয়ে এল আমফান।
বিশসাল নাকি বিষসাল?


মহানগরে তো ক্ষতির শেষ নেই। গাছপালা থেকে বইপত্র, জীবন থেকে জীবিকা সবই রসাতলে। আমাদের এদিকে ভয়াবহ কিছু ঘটেনি বটে, তবে মাঠে-মাঠে খরার ধানের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। নুয়ে-পড়া ধানগাছ জলকাদায় মুখ গুঁজে বসে আছে। এমন অবস্থা যে সেই ধান কাটার কোনও উপায় নেই। চাষীদের অনেকেরই নিজের জমি নেই। তারা জমির মালিকের কাছে টাকার বিনিময়ে জমি ভাড়া নিয়েছে। বিঘা পিছু ৩০০০-৪০০০ টাকা। এই আশায় ভাড়া নিয়েছে, যাতে, সেই জমিতে ধান ফলিয়ে কিছু অন্তত লাভ হয়। লাভ হলে সে-টাকায় তাদের জীবন কিছুটা স্বচ্ছল হবে। দুদিন পোলট্রির মুরগি খাওয়া যাবে। দেনাটাও একটু শোধ হবে। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই যে সে লাভের টাকা এখন বিশবাঁও জলে। আকাশে-আকাশে মেঘ ঘুরছে। মাঠে-মাঠে কান্নার ধ্বনি। গোঁ-গোঁ করছে চেন-লাগানো ধানকাটার মেশিন। ঘন্টা প্রতি ৫০০০-৫৫০০ টাকা। জমির ভাড়াটে কৃষকদের কথা ছেড়েই দিলাম, যারা জমির আসল মালিক, তারাও পড়েছে মহা ফাঁপড়ে। কারণ, অত টাকা ব্যয় করে ধানকাটার মেশিন লাগানোর ক্ষমতা তাদেরও আয়ত্তের বাইরে। ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি হয়ে যাবে! তবু মা-লক্ষ্মীর টান কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। মাঠের ধান মাঠেই পড়ে থাকবে, সেটা হৃদয়ে সইবে না। ফলে ঋণ। ঘটি-বাটি বন্দক। সত্যি বলতে, এখনও গ্রামেগঞ্জে মানুষ বিপদে পড়লে বিপুল সুদে মহাজনদের কাছে টাকা ধার নেয়। জমিজমা ঘটি-বাটি বন্দক রাখে। এমনকী নিজের বৌকেও গোপনে বন্দক রাখে, এমনও দৃষ্টান্ত আছে।
এরকম জমজমাট ধান্য সংকটে সরকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে বটে! কিন্তু ইন্সপেকশনের পর কবে সেই সহযোগ ফলপ্রসূ হবে, তা জানা নেই। তো, একবার কৃষি আপিসে কাগজ জমা পড়ল। তারপর তদন্তকারীরা এল। খবর পেয়ে তাদের পিছু-পিছু ছুটল কয়েকশো গ্রামবাসী। না, তাদেরও মুখে কোনও মাস্ক নেই। সোস্যাল ডিসট্যান্সিং নেই। তারা মাত্র কয়েকটি নোটের জন্য জলকাদায় ছুটছে।
— দেখবেন স্যার, আমারটা যেন বাদ না যায়!
বুকে ফর্ম ঝুলিয়ে ছবি তোলা হচ্ছে। ছবি তুলছে যে ছেলেগুলি, তাদের সারাবছর কেউ পাত্তা দেয় না। কিন্তু আজ তারা কেউকেটা।
— আরে আমাদের হাতেই তো সব। কাকা, তোমার ক্ষতির পার্সেন্ট বাড়িয়ে দেব। কমপিউটারে আমরাই তো সব ডেটা তুলব। একটু চা-মিষ্টির ব্যবস্থা কোরো।
— আজ?
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, সন্ধেবেলা দেখা কোরো। তখনই সব বলে দেব।
— অ্যাঁ, বলো কী বাবা, চা-মিষ্টি?
— চা-মিষ্টি মানে চা-মিষ্টি! কী জ্বালা, এটুকুও বোঝো না!
— ক’টা তো টাকা পাবো বাপধন! তার ওপরে আবার ইসব!
— তাহলে আর কী! যা ভালো বোঝো করো। নিজের ভালো তো আর বুঝলে না!
— ও কাকা, আমরা সবাই দিছি গো! না দিলে হবে না।
পাশ থেকে জানালো এক নওল কিশোর! ওর কথাতেই কাকা আর কথা বাড়ালো না। ছেলেটা বড় ভালো! ছোটো মেয়েটার সঙ্গে বে হলে মন্দ হয় না! বড়মাঠ থেকে বেলেমাঠ কাদাপায়ে ছুটে বেড়াচ্ছে ক্যামেরাম্যানের দল। কৃষিদপ্তরের আধিকারিকেরা মেপে নিচ্ছে ক্ষতির খতিয়ান। সেই লুঙ্গিপরা পার্টির নেতাটি একে-তাকে নির্দেশ দিচ্ছে। অকারণ হাঁকডাক করছে। গোটা একটা দিন, দিনের পর দিন, দু'দিন তিনদিন কেটে যাচ্ছে এইভাবে। আসলে কিছুই কাটছে না। একটা অদৃশ্য সরু তারের ফাঁস চেপে বসছে গলার ওপরে। এই সেদিন রিলিজ করা ‘গুলাবো সিতাবো’ সিনেমার ভাড়াটিয়াদের মতো সমগ্র গ্রামের লোক ছুটে বেড়াচ্ছে একটা অসহায় স্বপ্নের পিছনে। ক'টা টাকার জন্য তাদের সে কী হুড়োহুড়ি!


ক্ষতিতে-ক্ষতিতে ঝুঁকে পড়া ধানের জন্য তাদের সে কী উচাটন! অথচ সারা দেশে নাকি লকডাউন চলছে! লকডাউনের ভয়ঙ্কর সাফল্যের পর আনলকও শুরু হয়ে গেছে! এত সাফল্য যে দিনের পর দিন করোনাক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে! প্রথম হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে আমাদের দেশ। অথচ লকডাউনের শুরুর দিনগুলি মনে পড়ে? কেউ জানলো না, রাতারাতি সব বন্ধ হয়ে গেল। শ্রমিকদের ন্যূনতম আর্থিক নিরাপত্তা বা খাওয়া-দাওয়ার কোনো ব্যবস্থা হল না। অনিকেত হয়ে পড়ল তারা। নিরুপায় হয়ে তারা হাঁটতে লাগল। খালি হাঁটতে লাগল। দিনে হাঁটা। রাতে হাঁটা। হাঁটতে-হাঁটতে ঘুমিয়ে পড়ল রেললাইনে। ট্রেন চলে গেল তাদের মাথার ওপর দিয়ে। ঝমঝম-ঝমঝম করে সমস্ত রক্তাক্ত-জ্যোৎস্না খান-খান হয়ে গেল। ‘কোনোদিন জাগিবে না আর/ জানিবার গাঢ় বেদনার/
অবিরাম-অবিরাম ভার/ সহিবে না আর’— তবে এই কি সেই অদ্ভুত আঁধার? যে-আঁধারের ভিতর আমরা ঢুকে পড়েছি বহুদিন আগে কিন্তু বুঝতে পারিনি। এই অকস্মাৎ করোনা পরিস্থিতি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, তোমরা কেউ নও। শুধুমাত্র এক খামখেয়ালি দেশের কিছু পুতুলমাত্র। তোমাদের জন্য কোনও সুরক্ষা নেই। ভালোবাসা নেই। মহামতিরা হাত তুলে নিয়েছেন। এবার মুখে মাস্ক বেঁধে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে নাও।
আচ্ছা, একটা থ্রি-লেয়ার মাস্কের যেন কত দাম? একটা হ্যাণ্ডস্যানিটাইজের দাম কত? কারা কিনতে পারবে এসব?
বাড়িতে-বাড়িতে সব ঠিকে কর্মসহায়িকাদের চাকরি চলে গেছে। তাদের সঙ্গীরা, যারা কেউ টোটো চালাত, কেউ অটো, কেউ বাসের খালাসি বা কেউ হয়তো ড্রাইভার বা অন্য কিছু, তারা সবাই কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসে গেছে। রোজগার নেই। তাদের ক'জন যথাস্থানে কাজে ফিরতে পারবে ? অন্যান্য বেসরকারি সংস্থায় যারা কাজ করত তাদেরই বা কতজন বেতন পাচ্ছে ঠিকঠাক? চাকরি যায়-যায় অবস্থা কত মানুষের! কত মানুষের চাকরি আছে অথচ বেতন নেই! ওভেন আছে অথচ রান্না নেই! বঁটি আছে অথচ তরকারি নেই! হাঁড়িতে পাথর চাপিয়ে ছেলেভোলানো রান্না চলছে, এ ছবিও তো দেখেছি আমরা।
এসবের মধ্যে একটা অন্যরকম মর্মান্তিক খবর কিছুতেই ভুলতে পারব না। ৫৪ বছরের থমাস শেফার ছিলেন জার্মানির হেসে প্রদেশের অর্থমন্ত্রী। তিনি করোনার জন্য দেশের আর্থিক অবস্থা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন নাগরিকদের জন্য কিছু করার। বেশ কিছু প্যাকেজও দিতে পেরেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত সেই দুর্দশাগ্রস্ত নাগরিকদের জন্য তেমন কিছুই করে উঠতে পারছেন না, এই মনোকষ্টে তিনি আত্মহত্যা করেন। এখন আমরা গাঢ় হেসে খুব জোরের সঙ্গে বলব, আত্মহত্যা কোনও সমাধানের পথ নয়। কিন্তু কোনওদিন কি এই সংবেদনশীল মনটিকে বুঝবার চেষ্টা করব? যে-মন নিজের জন্য নয়, জনগণের জন্য কিছু করতে না-পারার ব্যর্থতায় নিজেকে শেষ করে দিয়েছে!
আমরা এসব বুঝব না। কারণ, আমাদের এখানে রাজনীতি, রোজগার করার একটি শ্রেষ্ঠ পথ। বছর পাঁচেক এইপথে থাকলেই আজকাল কোটিপতি হওয়া যায়! অনেককেই দেখেছি, এখনও দেখছি, সব পথে ব্যর্থ হয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর রাজনীতি করতে এসে দিব্যি চকমেলানো বাড়িঘর করছে। গাড়ি কিনছে। কোনও একটি নির্দিষ্ট দল নয়, ক্ষমতাসীন দল হোক বা বিরোধী দল, সবাই জ্যোৎস্নালোকে মায়ার আংটির কারবারী। আমরা সেই জ্যোৎস্নায় হারিয়ে যাওয়া মায়ার আংটি আঙুলে ধারণ করবো বলে, এর হাতে ধরছি, তার পায়ে পড়ছি, আর সংকটে-সংকটে আস্ত একটা সভ্যতার মেরুদণ্ড রোজ বেঁকে যাচ্ছে। কয়েকটি পোষা চেয়ারের ওপর সেই মেরুদণ্ডের ছায়া টুকরো-টুকরো হয়ে পড়ে থাকছে।
আর আমরা বোকার মতো ভাবছি, টিকা আবিষ্কার হয়ে গেলেই বুঝি আমাদের অসুখ সেরে যাবে!

Post a Comment

0 Comments