লকডাউনের দিনলিপি


অন্তরীণ দিন শেষের গল্প

সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায় । ৮ জুন, ২০২০ । নিউ জার্সি 


শির্বাদ না অভিশাপ? মুক্তি নাকি মৃত্যুর হাতছানি? জানি না!
ভবিষ্যতের অজানা পাতায় হয়ত সময়ের কলমে লেখা হবে এইপ্রশ্নের উত্তর। তবে অন্তরীণ জীবনের দিনলিপি লেখার আজ শেষ দিন…। স্বেচ্ছা নির্বাসনের এই লিপিতে গ্রন্থিত কী শুধুই আমার যাপন কথার ফুল? না এ গাথা সপ্তপদীতে কখনও করোনা আক্রান্ত দুপুরগুলোর পারসোনাল ন্যারেটিভ। কখনও মৃত্যুর ভয়ে থার্মোমিটারের পারার উঠা নামায় বিকেলের কবিতার আড়াল। কখনও অক্সিমিটারের অক্সিজেন লেভেলের পারসেন্টেজে ভোরের লিরিকাল গদ্য, এক অদ্ভুত ছন্দে বাঁচার আনন্দ। এ যেন পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ ও প্রকৃতির সাথে সাথে আমারও এক পরীক্ষার কাল। ভেসে থাকা বিষাদের প্রান্তে আমার অ-সুখ যেন আমারই মনের আয়না, যার প্রতিবিম্বে মধ্যবিত্ত গার্হস্থ জীবনের বিপরীত একছায়া, বহতা নদীর মত ছুঁয়ে গেল আমার যাবতীয় সুখ অসুখ, ব্যথা আনন্দ, চাওয়া পাওয়া, স্মৃতি বিস্মৃতির গড়া… কখনও নির্বেদ শূন্যতায় পুরোনো সম্পর্কের ছেঁড়া তারের টান। কখনও আবার নতুনের আধারে এক অলৌকিক মায়াপ্রান্তর। অলীক সংলাপে এক আশ্চর্য আলোর সেতু… এ যেন একবোধহীন সময়ের মরিচীকার হাতছানি। সাথে গাঁথা রয়ে গেল সমস্ত পৃথিবীর অসুখের দিনলিপি। প্রকৃতিও শেখালো অনেক কিছু, বোঝাতে চাইল সভ্যতার তপ্ত বায়ুর বিষ কিভাবে বিষিয়েছে তার ফুসফুস! চেনাল সুর্যাস্তের রক্তরাগে ঘরছাড়া পাখিদের নীড়ে ফেরার পথ, অন্তরীণ নিস্তরঙ্গ জীবনে পাতাদের ফিসফিস শোনালো নিরাপদ ঘর ও তার আশ্রয়ের গল্প।
আমার পরিযায়ী জীবনের হৃদয়ে জড়িয়ে গেল জামাল মাকালো আর অসংখ্য ঘরে ফিরতে চাওয়া শ্রমিকের ফাটা পা, অনাহার…ওদের সাইকেল, রিক্সা আর পিষে ফেলা ট্রাকের চাকার দাগ মিশে গেল আমার ফুসফসের মাংসল ক্ষতে। আমার জ্বরের বেহুঁশ ঘুমে কাটা পড়ল রেললাইনের ক্লান্ত ঘুম। বালিশের পাশে পরে রইল রক্তমাখা চটি আর ক্ষিদের রুটি। আমার মনের আশংকার ঝড় ওঠালো তিলোত্তমার বুকে উম্পুন, ভেসে গেল বইপাড়া। সুন্দবনের চর… শহরজুড়ে বস্তির না খাওয়ার করুণ সুরে বাউন্ডুলেদের ত্রাণের জীবনমুখী পাগলামির গান…। যখন প্রপিতামহের দাসত্বের ইতিহাস মনে রেখে কারো প্রভুত্বের হাঁটু চেপে ধরল এক অসহায় সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের গলা, তখন সাদা, কালো, হলুদ, বাদামীর রক্ষণশীল বর্ণের বৈষম্য ভেঙে কিছু মানুষ, শুধু ভালবেসে বুক পেতে গ্রহন করল রবার বুলেটের ব্যথা, চোখের পাতায় মাখল পেপার স্প্রে।
দেশ কালের বৈষম্য ভাঙা এই বিদ্বেষ তো আবহমানকালের, শূন্যগর্ভ প্রভুত্বের আস্ফালণে যা দিকে দিকে ক্রমাগত বাড়ছে তাই আমার যন্ত্রণার অস্থির তরঙ্গের সাথে জুড়ে গেল জর্জ ফ্লয়েডের বান্ধবীর দমচাপা কান্না। আমার শ্বাসহীন গলায় ফ্লয়েডের আর্তনাদ বারো বারের আর্তনাদ ‘I can’t breath’… এখন ক্রান্তিকাল! এ কাল সাক্ষী রইল এক আশ্চর্য প্রতিবাদের। শহরময় সতর্কতা তবুও প্রতিটি রাতের দেদীপ্যমাণ ধ্বংসাবশেষ পেরিয়েও নেমেছে মানুষ নামের ঢল। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলে এভাবেই আসে জোয়ার। এই যে এক থেকে অনেক হওয়া জনস্রোত আজ একত্রিত, এদেরও আছে পুঞ্জিভুত ক্ষোভ, ফেটে পরার আবেগ! তাদের মিলিতস্বর চিৎকার করেছে জাস্টিস চাই…। দশদিনের অগ্নিগর্ভ প্রতিবাদ… উত্তাল গোটা দেশ, ব্যথিত সারা বিশ্ব। দায়ী যারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে  #blacklivesmatter— রেহাই পায়নি ডেরেক শভিন তার সহযোগী তিন পুলিশকর্মী।
আজ প্রতিবাদীদের জয়ের আনন্দে মিশে গেছে আমার করোনা জয়ের আনন্দ। ঘিরে থাকা এক ছায়াময়, মায়াপ্রান্তরের আলো মেখে আমার উজ্জ্বল যে সব দিন। স্বেচ্ছায় সরে গেছে ভালবাসা থেকে দূরে। তারা আমার খোলা বেদূইন হাওয়া মাখা মনের গোপন বারান্দা। কোনও এক মনখারাপের বাদলা দিনে আমি হয়তো বসব তার এক নির্জন কোণে হাওয়া মেখে আবার বৃষ্টি হব… চোখের কার্নিশ বেয়ে ঝরবে আমার জমানো ব্যথার দানা।

Post a Comment

0 Comments