ব্লগ : ওদের কথা/ ৬

ওদের কথা/ ৬

মাস্কের নীচে হাসি

মঞ্জীরা সাহা


ন্ধ হওয়া কচুরির দোকানটা ছাড়িয়ে গিয়ে চৌরঙ্গী মোড়। রাস্তাটা সোজাসুজি ক্রস করে রেল গেট। বাঁ দিকে তাকালে খাঁ খাঁ করছে মৃদু মৃদু আলো জ্বলা শ্যামনগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্ম শেষের ঢালুটাতে সন্ধে বেলা মাসরুমওয়ালা আর বসে না। জায়গাটা অন্ধকার গেট ক্রস করে গেলেই ফিডার রোড। পুরো রাস্তাটা সেই লকডাউনের প্রথম দিন থেকে অচেনা হতে শুরু করেছে। আলো অর্দ্ধেকের বেশি নেবা। কারুর মুখ চোখে চৌরঙ্গী মোড়ের অটো ধরার তাড়া নেই। কেউ আজকাল ছোটে না। মাস্ক পরা মুখ গুলো কেবল মাটির দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলে যায়। মাস্কের উপর দিয়ে চোখগুলোর চাউনিতে কেমন একটা ভয়!
গল্পের প্রসঙ্গ গুলো সব কেমন বদলে গেছে। বাজারের ব্যাগ হাতে মাছ মাংস শব্জির দিকে তাকিয়েই একবার করে চোখ বুলিয়ে নেয় পাশের লোকটার দিকে। দাঁড়িপাল্লার ওজন বটি আর মাছওয়ালাকে সন্দেহটা এখন ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের মানুষগুলোর দিকেও। বাবা মায়েরা এখন ছেলে মেয়ের প্রেমের সন্দেহ করে না। আশপাশের বাড়ির মানুষকে সন্দেহ করে বেশি বেশি করে। এই বুঝি কেউ ঢুকেছে এসে পাশের বাড়িতে। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব। কোচিং ফেরত পথে অন্ধকার গলিতে কেউ প্রেমিকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে না। চোখ ফিরিয়ে নিতে হয় না কানা গলির অন্ধকারে। হিট বই এর হিট গান ভুল কলিতে গাইতে গাইতে পাশ দিয়ে কেউ চলে যায় না। 
পাড়ার মোড়ের বাতি স্তম্ভে পার্টির মিটিঙের স্টেজ বাঁধা হয়নি অনেক দিন। চোঙের আওয়াজ শুনিনি বহুদিন। ফিডার রোডের পার্টি অফিসের সামনে চেয়ারে বসে বসে মাস্ক আঁটা মুখ গুলো কিসের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদের কথা বলে কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা যায় না।
কাল সন্ধেতে বেরিয়েছিলাম অনেক দিন পর। এক খানা স্টেশনারি দোকানে গিয়ে খোঁজ করছি অ্যালকোহল মেশানো স্যানিটাইসারের। হঠাৎ পাশ থেকে চড়া একটা গন্ধ নাকে এল। কিরকম ঘামের! না না শুধু ঘামের তো না। সাথে চোলাই মতো কোনও বস্তুর গন্ধ মিশে একটা গা গোলানো ব্যাপার। ডান পাশে তাকিয়ে দেখলাম একটা কালো রঙ উঠে ধূসর হয়ে যাওয়া স্যান্ডো গেঞ্জি-লুঙ্গি পরা সতেরো আঠারো বছরের ছেলে। রিকশটা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে নেমে এসেছে দোকানটায়। জড়িয়ে জড়িয়ে বলছে ফেয়ার এন্ড লাবলি ক্রিম আছে?
দোকানদার ভ্রুটা ঘুঁচকে কিছুটা বিরক্তির সুরে বলছে, কি বলছ কি চাই?
আরে জানেন না ফেয়ার এন্ড লাবলি। ওই যে মেয়েছেলেরা মুখে মাখে না। ওই তো কাচের ভেতরে ওই-টা না?
আরে কোথায় ফেয়ার এন্ড লাভলি? ওই প্রোডাক্ট কোথায় দেখতে পাচ্ছো? আমরা ওসব রাখি না।
জানি না আদৌ ছেলেটি নেশার ঘোরে কি দেখল।
বিদেশ থেকে ফ্লাইটে চড়ে রোগ এল। বিদেশ থেকে তার সাথে পি পি ই এল। মাস্ক গ্লাভস স্যানিটাইজার ছড়িয়ে গেল বাজারে। লকডাউন, কোয়ারেনটাইন, সোসাল ডিস্ট্যান্সিং শব্দগুলো জুড়ে গেল কথার সাথে। ভাবলাম এ পৃথিবীতেই মাস্ক-স্যানিটাইজারের বাইরে ভাইরাসের ভয়ের বাইরে সে কোন প্রেমিকা, ওই একখানা ক্রিম মেখে ফর্সা হওয়ার অপেক্ষায় আজো বসে আছে!
সেই ক্রিম কিনতে আসা রিকশচালক প্রেমিকের মুখে মাস্ক নেই। ঢুলু ঢুলু চোখে করোনা ভাইরাসের ভয় নেই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভদ্রমহিলার করোনা আছে কিনা সে সন্দেহ নেই। শপিংমলে প্রেমিকাকে নিয়ে শপিং করতে যাওয়ার অপেক্ষা নেই। শুধু আছে একখানা মুখ আর ওই এক ফর্সা হওয়ার ক্রিম।
ফেরার পথে চৌরঙ্গী পার করে গঙ্গার দিকে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম মেঘের ফাঁক দিয়ে জৈষ্ঠের পূর্ণিমার চাঁদ মুখ বার করছে। লেয়ারের পর লেয়ার চাপা মাস্কের ভেতরেও যে হেসে ফেলেছি বুঝতে পারলাম। আধ খানা দরজা খোলা— চা এর দোকানে এফ এম এ গান বাজছে— ‘‘আকাশে কার বুকের মাঝে/
ব্যথা বাজে/ দিগন্তে কার কালো আঁখি/ আঁখির জলে যায় ভাসি/ ভালোবাসি...।’’ 

Post a Comment

0 Comments