ব্লগ : স্বগতোক্তি/ ৪ । অমিতাভ আমাদের সেই পৌরুষ

অমিতাভ আমাদের সেই পৌরুষ

তড়িৎ রায় চৌধুরী 


চ্চনসাব অসুস্হ না হলে আমি জানতেই পারতাম না খোদ কলকাতায় আস্ত একটা অমিতাভ ধাম মানে মন্দির আছে। কে যে কাকে দেবতা ভাবে আর/ কোন মন্ত্রে পূজা করে তার? জীবিত মানুষের মন্দির! কোন রূপে পূজা পান তিনি? তাঁর মূর্তিরও কি রূপবদল হয়? কে কোন ভাষায় বানিয়েছে তাঁর পূজার মন্ত্র? কি ভাবে ঠিক হলো পূজার আনুষ্ঠানিকতা? আমি এসব কিছুই জানি না, কিন্তু জানতে খুব ইচ্ছা হয়। না বিপুল ভক্তি বা তুচ্ছ অনুকম্পায় নয়। জন মনের গতি অনুধাবনের বাসনায়।
এই তো প্রথম না। ইতিহাস বলছে ১৯৯৮তেই মেসির জন্ম শহর রোজারিও তে তৈরি হয় মারাদোনা গির্জা। লেখা হয় টেন কম্যান্ডমেন্টস। যেখানে অনিবার্য উপস্থিতি পেলের। free us from Havelange & Pele. আসলে যুদ্ধ জয়ের গৌরবেই তো মানবের দেবায়ন ঘটে। মানুষ আর মানুষ থাকে না তখন। ৩০ অক্টোবর জন্মদিনে দীক্ষা উৎসব হয় গির্জায়। দূরাভাষে আসে তাঁর স্বর। কমিউনিস্টেরও হয়তো ঈশ্বর হবার সাধ হয়।
ভক্তের কাছে ভগবানের কোনও ব্যাখ্যা হয় না। কোনও প্রমাণ হয় না। শুধু নিজেকে ঢেলে দেবার মহত্বটুকু ছাড়া আর সবই বাহুল্য। নিজেকে ভুলে যাবার দুরন্তপনা থেকেই ভক্তির জন্ম। ভক্ত করিছে প্রভুর চরণে/ জীবন সমর্পণ। ভারতবর্ষে গুরুবাদ, ভক্তি আন্দোলনের ইতিহাস অতি সমৃদ্ধ। বলা যায় ঐতিহ্যের অঙ্গ। গুরুবাদী দেশ আমাদের। নানারূপে নানাভাবে গুরু প্রসঙ্গ এদেশের পাতায় পাতায়। দেবগুরু থেকে গুরুদেব হয়ে অধুনা মহাগুরু আর ম্যানেজমেন্ট গুরুদের যুগ। দীর্ঘ বিচিত্র সে পথ।
রাজেশ খান্নার মায়াময় মোহের আবহ ভেঙে পেশাদার নায়কপনা এনেছিলেন অমিতাভ। তিনি সেন্ট পার্সেন্ট পারফরমার এই তাঁর পরিচয়। তবু কালে কালে ভক্তদল তাকেও ভগবান বানালো। তাই হয়। তাই হয়েছে চিরকাল। ব্যাস থেকে বুদ্ধ সকলেই গুরুপূর্ণিমার গল্প। আমার ঘরে অন্য কোনও ঠাকুর নেই এক রবিঠাকুর ছাড়া। অন্য কোনও ঠাকুর নেই রবিঠাকুর ছাড়া! নিরাকার উপাসক ঠাকুরের ছবিতে ফুলপাতা চড়াতে চড়াতে কে জানে কোনদিন নকুলদানাও পড়বে পাতে। অথচ  ঠাকুর তো পদবী মাত্র! যদি কুশারীই থেকে যেতেন? কিছু এসে যেত না। রামকৃষ্ণ তো কতজন; ঠাকুর একজনই। কবিগুরু যেভাবে শুধু কবি নন গুরু; বলা ভালো শুধু গুরু নন দেবতাও---গুরুদেব। তেমনি রামকৃষ্ণ মিশনের বৃহৎ প্রেক্ষাপটে তিনি ঠাকুর। আচ্ছা তিনি ঠাকুর অথচ সারদামণি আমাদের মা। কেন? তবে কি গুরুবাদের শিকড়েও রয়েছে পুরুষমন? গুরু শব্দের লিঙ্গান্তর তো গুর্ব্বী। তিনি মহিলা গুরু নাকি গুরুর পত্নী? নতুনরূপে ফিরেছে গুরুমা শব্দটা। আসলে মেয়েরা মায়ের জাত। গুরুত্ব বাড়লেও মাতৃত্বই তার মুখ্য শোভা। তাই সফলতম মহিলা খেলোয়াড় বা শিল্পীকেও সহজেই প্রশ্ন করা যায় মা হচ্ছেন কবে? একজন অসফল মা, একজন না-হওয়া মা কি যথার্থ মানুষ হতে পারেন না?
হয়তো অনেককিছুর মতোই ভক্তিরও কিছু নিজস্ব শর্ত আছে। পুরুষ মানে পাহাড়। সুউচ্চ শরীর। মেঘনাদ স্বর। সত্যজিৎ বা অমিতাভ আমাদের আইকোনিক পৌরুষ। আমরা মরে গেলেও মানতে চাই না রবীন্দ্রনাথের গলা ছিল সরু। ঋতুপর্ণকে সত্যজিতের উত্তরসূরী ভেবেছি ততদিন যতদিন সে নিজের মেয়েলিপনা নিয়ে মাতামাতি না করেছে। আসলে যে কোনও ক্ষেত্রেই  ভোক্তা যখন ভক্ত হয়ে ওঠেন তখন আর কাজের মান নয় মত্ততা মুখ্য হয়ে যায়। উৎকৃষ্টতাকে প্রতিস্থাপন  করে উন্মাদনা। আর তার ফল? ১৯৯৩-এর ৩০ এপ্রিল টেনিস কোর্টেই আক্রান্ত হলেন মনিকা সেলেস। কুড়ি বছরের কম বয়সেই আটটা গ্ল্যান্ড স্ল্যাম জিতে একনম্বরের সিংহাসন থেকে ছিটকে দিয়েছেন স্টেফি গ্রাফ কে। স্টেফির স্লাইসড ব্যাকহ্যান্ড পারছিল না তাই তার ভক্ত মারলেন পিছন থেকে ছুরি। চূড়ান্ত সফল তিনি। মনিকা আর ফিরতে পারেননি আগের ফর্মে। ভক্তই কি গড়ে তোলে ভগবানকে? নাকি তাকে ধ্বংসও করে? ১৯৯৪-এ ঘটনাক্রমে আত্মঘাতী গোলে দেশ কে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেবার অপরাধে প্রকাশ্য রাস্তায় ঝাঁঝরা হয়ে যান কলম্বিয়ার ফুটবলার এসকোবার। মনে পড়ে শাহরুখ অভিনীত ফ্যান ফিল্মের কথা। ফ্যান তো ফ্যানাটিক। চেতনায় স্থিরতা নেই কোনও। গুরুরাও কি আক্রান্ত হন না ভক্তব্যাকুলতার জ্বরে। দর্শকদাক্ষিণ্যের ছত্রছায়ায় অভ্যস্ত জীবনও নির্জন আর বিপন্ন বোধ করে না নিজস্ব স্বাভাবিক মানুষিক যাপন ছন্দে? গুরু তো গুরু নন তিনি গুরুদেব।
— ওরা যে তোমায় দেবতা বলে জেনেছে।
— তাই আমাতেই এসে ঠেকে গেল, ভিতর থেকে যিনি ওদের চালাতে পারতেন বাইরে থেকে আমি তাঁকে রেখেছি ঠেকিয়ে।
এভাবে জাল ছিঁড়তে পারে কজন।
— তুমি আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে? আমাদের ভালবাস না?
— ভালবেসে তোদের চেপে মারার চেয়ে, ভালবেসে তোদের ছেড়ে থাকাই ভাল।
তাই বললে কি হয়। মায়ার সংসার। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকাই তো জীবন। কে না জানে ভক্তি কোন যুক্তি মানে না।

Post a Comment

2 Comments

  1. এক অনুভবী বিশ্লেষণ। বড় ভাল লাগল। ধন্যবাদ। অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  2. "অমিতাভ আমাদের সেই পৌরুষ ",আজ পর্যন্ত তড়িৎ এর সেরা লেখা।গুরু কেমন করে গুরুত্বপূর্ণ,গুরুতর হন, কীভাবে সেই প্রতিমূর্তি গড়ে ওঠে আমাদের সমাজ পরিকাঠামোয়, আমাদের বাঁধাধরা জীবনে, মননে, চেতনে, অবচেতনে, আমাদের বিজ্ঞাপনে আমরা জানি। তবে সারদাকে মানুষ মাতৃরূপে যতটা আপন করে পেতে চান ততটা মনে হয় গুরু বা গুরুমা এই তকমাতে পাননা বা ওই বিশেষণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।আবার রামকৃষ্ণকে বাবা ভাবলেও কেমন একটা লাগে মনে হয় !একটা সংখ্যক মানুষ তাঁরা রবিকে, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, সারদা, এমনই মানুষ বা মানব মানবীকে মনের সিংহাসনে বসিয়ে পূজা করেন। হয়তো ফুল দেন, প্রসাদিও দেন। খুব ভাল লেগেছে এই লেখ।অপেক্ষায় রইলাম আরও।

    ReplyDelete