চাকা ঘুরছে শিল্পাঞ্চলে

চাকা ঘুরছে শিল্পাঞ্চলে

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়


খনও মনে আছে— ‘কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে৷ কেহ কাহার চিকিৎসা করে না ; কেহ কাহাকে দেখে না ; মরিলে কেহ ফেলে না ৷ অতি রমনীয় বপু অট্টালিকার মধ্যে আপনা আপনি পচে৷’
এই ভাবেই বঙ্কিমচন্দ্র ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় মহামারীর বর্ণনা করেছিলেন ৷ একবিংশ শতকের ভয়াবহ মহামারী করোনা ভাইরাস রোগ বা কোভিড-১৯ ৷ বিশ্বের ১৮৫টি দেশে এক কোটির উপর মানুষ এখনও পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন কোভিড-১৯-এ৷ আমাদের দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও ভয়ঙ্কর। মৃতের সংখ্যা যদিও সুস্থতার সংখ্যার তুলনায় অনেক কম ৷ কিন্তু সংক্রমণ যেভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে তাতে যে কোনও পরিসংখ্যান প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে৷ আর বদলাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন আর্থ-সামাজিক জীবন যাত্রা৷ ক্রমশ বদলে যাচ্ছে আমাদের অভ্যাস৷ এই মহামারীর কারণ, এর থেকে নিষ্কৃতির উপায়, ভ্যাকসিন আবিষ্কার, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির উপায় ইত্যাদি আজ আমাদের প্রতিদিনের চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় শিল্প তালুক এই করোনা আবহ থেকে কোনও ভাবেই মুক্ত নয় ৷ গত চার মাসে দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চলে করোনা সংক্রমণ ব্যাপক ভাবে বিস্তার লাভ করতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু সব স্থানের মতো এই অঞ্চলেও কৃষি, শিল্প, শিক্ষা এবং সামাজিক সচলতার ক্ষেত্রে এক বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে৷
জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চল ভীষন ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ লকডাউন পর্যায়ে বৃহৎ-মাঝারি-ক্ষুদ্র মিলিয়ে প্রায় তিনশোটি কল-কারখানা বন্ধ৷ কয়লা খনি অঞ্চলের কৃষি জমিগুলি এমনিতেই চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে৷ আর যেটুকু জমিতে চাষ হবার কথা, করোনার আবহে তাও বন্ধ৷ কারখানা-শ্রমিকদের পাশাপাশি ঠিকা চাষী, বর্গাদারী চাষীরা প্রায় বেকার হয়ে পড়ছে৷ সবচেয়ে করুণ অবস্থা অসংগঠিত কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের৷ ইটভাটা, গৃহ নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, পরিবহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসংগঠিত শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন৷ সরকারি সাহায্য বলতে রেশনের খাদ্যদ্রব্য আর একশো দিনের কাজের প্রকল্প৷ কিন্তু নানা কারণে পদক্ষেপ গুলি পর্যাপ্ত নয় বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন৷
লকডাউন পর্যায়ে শিল্পাঞ্চলের বাজার ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছিল৷ চৈত্র সেলের সময় বড়ো ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ দুর্গাপুরের বৃহৎ বেনাচিতি বাজার, চন্ডীদাস মার্কেট, আসানসোলের হর্টন রোড মার্কেট, হকার্স মার্কেট বিশাল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে৷


প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমফানে রাঢ়-শিল্পাঞ্চলে ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক ভাবে কম হয়েছে৷ দুর্গাপুর-২ এবং পান্ডবেশ্বর বিধানসভা এলাকায় কয়েকটি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে কিছু গাছ উপড়ে গেছে৷ ত্রানের কাজ বিলম্বে হলেও হয়েছে৷ কিন্তু মহামারীর এই কালে কর্মহীন হয়ে পড়া সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ যেভাবে অসহায় পড়েছে তাতে বেঁচে থাকাটাই এখন মহার্ঘ্য৷ বিভিন্ন রাজ্য থেকে ফিরে আসা শ্রমিকরা আজ ‘পরিযায়ী’ বিশেষণে ভূষিত হয়েছেন ৷ ভিন রাজ্য থেকে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক শিল্পাঞ্চলে ফিরে এসেছেন৷ ফিরে আসা এইসব শ্রমিকদের কি আশ্চর্য রকম ভাবে বাঁকা চোখে দেখা হচ্ছে; হয়তো অনেকের এও মনে হচ্ছে, ওরা অন্য গ্রহ থেকে আসা ‘অন্য প্রাণী’৷ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের সমস্ত নির্দেশিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নির্বিচারে চলছে অনিয়ম৷ সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখেই একদিকে হাটে-বাজারে বিকিকিনি চলছে, আর অন্যদিকে বাড়িতে আসা কাজের মাসি, কিনু গোয়ালাদের ঘৃণা, সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে৷ আর রাত্রে টিভিতে সরকারি বিজ্ঞাপন দেখে আনুষ্ঠানিক মনোভাবে দর্শক-বৃন্দ বলছেন, ‘রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করুন রোগীর সঙ্গে নয়৷’ এ এক আশ্চর্য সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি৷ একদিকে জীবন-জীবিকার সংকট আর অন্যদিকে অস্পৃশ্যতা, সামাজিক বৈষম্য ফুটে উঠছে৷
দেহাতি, দিন আনা দিন খাওয়া অসহায় মানুষ গুলি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ জোগাড় করতেই হিমসিম খাচ্ছে, আবার সুচিকিৎসা!


তাদের কাছে এ এক দুষ্প্রাপ্য পরিসেবা৷  লকডাউন পর্বে ইচ্ছাপুরের কুমোর পাড়ার এক নিম্নবিত্ত পরিবারের করুণ ছবি আমার চোখে ধরা পড়ে৷ পরিবারটির মূল জীবিকা মাটির কলসি, কুঁজো,ভাঁড় তৈরি করে বিক্রি করা৷ একদিন কলসি কেনার জন্য সেখানে যাই৷ কিন্তু বিক্রেতা জানায় খদ্দের নেই বলে এখন আর মাটির জিনিষ বানায় না৷ সে এখন দিন মজুরি করে; তবে প্রতিদিন কাজ পায় না৷ অন্যান্য জায়গার মতো শিল্পাঞ্চলেও পেশা পরিবর্তনের হিড়িক লেগেছে৷ এম.এ পাশ করা প্রাইভেট টিউটর লকডাউনের কবলে পড়ে সবজি বিক্রি করছেন৷ আবার স্বর্ণকারের দোকানে সোনা-রুপোর পরিবর্তে গোলদারির জিনিস বিক্রি করতে দেখা গেছে৷
আনলক পর্যায় শুরু হবার পর থেকে শিল্পাঞ্চলে অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে৷ কারখানাগুলি তাদের উৎপাদন শুরু করেছে৷ শ্রমিকরাও ধাপে ধাপে কাজে যোগ দিচ্ছেন৷ চাষীরাও বর্ষার জল পেয়ে মাঠে ধানের বীজ বপন করতে শুরু করেছেন৷ দোকানপাট খুলতে শুরু করায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা আশার আলো দেখছেন ৷ আসলে জীবন কোন কিছুর জন্য থেমে থাকতে পারে না ৷ করোনা মহামারী আমাদের মানব জীবনে এক মহা সংকট নিয়ে এসেছে -- এটা যেমন সত্যি ; তেমনি বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সামিল হয়ে মহামারীকে সাথে নিয়েই চলতে হবে— এটাও সত্যি৷ জীবনের কোনও অভিজ্ঞতাই ছুঁড়ে ফেলে দেবার মতো নয়৷ করোনো আমাদের যেমন অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, দিয়েছেও অনেক কিছু৷ করোনা আমাদের শিখিয়েছে সামাজিক দূরত্ব নয়, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে৷ করোনা আমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে বাধ্য করেছে, যা শিক্ষনীয়৷ স্বেচ্ছাচারিতা, অমিতব্যয়ীতা যে আমাদের কাম্য নয় তাও করোনা আমাদের শেখাচ্ছে৷
আমাদের আশা আবার হাসবে শিল্পাঞ্চল, আবার আলোকিত হয়ে উঠবে গ্রাম ও শহর৷ খেটে খাওয়া সাধারন মানুষ পান্তা ভাতে নুনের ব্যবস্থার পাশাপাশি তাদের সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষার ব্যবস্থাটুকুও করে নেবেন— এ ভরসাও রাখি৷

Post a Comment

1 Comments

  1. দারুন লিখেছেন স্যার

    ReplyDelete