পান্থ/ ২ । ফুনশিলং-এ গোটা রাত


পান্থ/ ২

ফুনশিলং-এ গোটা রাত

দীপশেখর চক্রবর্তী

ফুনশিলং এর পাহাড় থেকে পায়ে হেঁটে নেমে আসছি আমি, কল্যাণ এবং সায়ন। পাহাড়ের কোলে বৌদ্ধ গুম্ফাতে অন্ধকার নেমে আসা কাব্যিক ছিল। তবে এই অন্ধকার পাহাড়ের পথ দিয়ে নীচে নেমে আসা তার থেকেও বেশি সুন্দর। উল্টোদিক দিক থেকে আসা গাড়ির বিপদ এড়ানোর জন্য আমরা পাহাড়ের খাদের পাশ দিয়ে হাঁটছি। এমনিতে আমার উচ্চতার ভয় তবে এখন সেসব পাত্তা দিলে চলবে না। পাহাড়ে হেঁটে ওঠার পরিকল্পনাটা আমারই, ফেরার সময় যে কোনও গাড়ি পাবো না এটা বোঝা উচিৎ ছিল। তবে সেই ভুল নিয়ে এখন দুর্বল হলে ওরা দুজন বেশ ঘাবড়ে যাবে। আমার এই যে কোনও বিপদে চোখ বুজে ঝাঁপিয়ে পড়ার ফলাফলটা তো বারবার ওদেরই ভোগ করতে হয়। এদিকে কল্যাণ প্রাণপণে একটা গাড়ি খুজছে, যাতে এই যাত্রায় প্রাণটা না খোয়াতে হয়। সায়ন অপেক্ষাকৃত নির্লিপ্ত। আমি প্রায় অন্ধের মতো চলেছি, জানি এমন অবস্থায় কোথাও একটা থেমে গেলেই বেশ বিপদ হবে। কিছুক্ষণ আগে পাহাড়ের গায়ে বিশাল বিশাল গাছের নৈঃশব্দ আমাকে ইহজগৎ থেকে স্বর্গের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। তবে এখন যা অবস্থা তাতে করে স্বর্গের দিকে যাত্রা করাটা ঠেকানোই আমার মূল উদ্দেশ্য। আচমকা দেখলাম ছোট একটা গাড়ি আমাদের অতিক্রম করে এগিয়ে থামলো। বুকটা ধক করে উঠলো। ছিনতাইবাজ যদি হয়?
অথবা পুলিশের লোক তো হতে পারে। আমরা ছাড়া কাউকেই আমি পাহাড় দিয়ে হেঁটে নামতে দেখছি নে। এদিকে ফুনশিলং অবধি আমাদের ঘোরার ছাড়। এসব ভাবার মধ্যেই দেখি কল্যাণ প্রায় জানলা দিয়ে গাড়িটার ভেতর গলে আমাদের ডাকতে লাগলো। আমরা স্তব্ধ।
মুখে অনেক বিরক্তি প্রকাশ করলেও মনে মনে শান্তিই পেয়েছি। মানুষ যখন বিপদ থেকে উদ্ধার পায় তখুনি সদর্পে অনেক বীরত্বের কথা বলতে পারে। আমিই বা ছাড়ি কেন। ড্রাইভার অনেক গল্প করলো সেই ছোট্ট রাস্তাতেই, তারপর একটু গলা নামিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল— কোন হোটেলে নিয়ে যাবে আমাদের।
এই এক বিপদ। আমরা কোনও হোটেল তো ভাড়া করিনি। এটার ভাবনাও আমার। হোটেল ছাড়াই যে অন্য একটা দেশে খোলা আকাশের নীচে রাত কাটানো যায় এটা আমাকে সুখী মধ্যবিত্ত বাঙালিকে প্রমাণ করে ছাড়তে হবে। যদিও সে খবর কোন সংবাদপত্রে আজও ছাপেনি তবু আমার আত্মীয় স্বজনের কাছে এই কীর্তি একমাত্র দুর্ধর্ষ তাতার দস্যুদের ছাড়া আর কারও নেই। ড্রাইভার সেটি বুঝে গলার স্বর আরেকটু নীচু করে জানতে চাইলো— বিশেষ কোন হোটেলে সে নিয়ে যাবে কিনা?
তাকে মাঝপথে ছেড়ে দিতে প্রাণটা কেমন আনচান করে উঠলো। সকাল থেকে যা বুঝেছি তাতে করে ভুটান পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর দেশ না হোক ভুটানি মেয়েরা যে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দরী। তবে আমাদের হল পুলিশের ভয়। পকেটে টাকা নেই,মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। ফলে দশ কুড়ি বছর ভুটানের জেলে থেকে বিরাট দাঁড়ি গোঁফসহ কলকাতায় ফিরলে আমাকে মালা পড়িয়ে হুড খোলা জিপে বাড়ি ফেরানোর বিশেষ সম্ভাবনা দেখি না। দেখলেও,বনলতা সেনের মতো বাড়ির লোক এসে— ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ বলে আদর আপ্যায়ন করবে এই ভাবনাও মুণ্ডুহীন মানুষের হাসির মতন।
একটা খাওয়ার জায়গা খোঁজা দরকার। ফুনশিলং এসে আগাগোড়া ইউরোপীয় শহরের মতো লেগেছে,ফলে রাত্রিবেলা ফরাসি দেশের প্রেমিকের মতো রুটি এবং রেড ওয়াইন আমার পছন্দ। সায়ন আমার দলে। তবে কোচবিহারের ছেলে কল্যাণ। এই যাত্রার পূর্বে ওদের বাড়ি গিয়ে তিনবেলা ভাত খেয়ে আমাদের আইঢাই অবস্থা। কল্যাণ সেই গাড়িতে লাফানোর মতো ক্ষিপ্রতায় খুঁজে চললো ভাতের হোটেল! খাটি ইউরোপীয় শহরের রহস্যময় অলিগলির মধ্যে ঠিক খুঁজে বার করলোও।
তিনটি থালি এল। প্রতি থালিতে দশ রকমের আচার আর মহিষের মাংস। কলকাতায় বেড়াতে বেরোলে মিস্টির টাকাটা পকেটে যত্নে পুড়ে রাখি,ফলে সেসব আচারে দাঁত ফোটাতে পারলাম না। এমন ঝাল মনে হয় সৈনিকরা যুদ্ধের আগে খায়। মহিষের মাংসটা অমৃত ছিল, ওমন আগে কখনও খাইনি। কথায় কথায় জানা গেলো শেফ কলকাতার কাছে দমদমে দীর্ঘদিন একটা রেস্তোরাঁয় কাজ করে গেছে। সেই যত্ন করে খাওয়ানোর মধ্যে একটা বাংলার মা-মাসি ব্যপার ছিল। এমনকি চাইলেই সে আচারগুলো পুরো খাওয়ার জন্য জোর করে ফেলতো হয়ত। আমরাই মরতে চাইনি।
অথচ আমরা, রাতটা কাটাবো কীভাবে? চাপটা আমার ওপরেই বর্তাবে। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরার পর বুঝলাম রাত হতে যায়, ভুটান গেট থেকে দূরে যাওয়া দরকার। ওখানেই পুলিশের পাহারা বেশি। সিনেমা দেখে দেখে এমন ভয় ধরেছে যে বিদেশে যাদের ধরে সবাই গুপ্তচর। ছেচল্লিশ বছর বয়সে এসে মা যদি জানতে পারে তার ছেলে ভারতীয় গুপ্তচর হয়ে ভুটানে আটক তাহলে গর্বিত হবে নাকি লজ্জিত হবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
সায়ন একটা হোটেল নেওয়ার কথা বলল। কথাটা আমার মাথাতেও একথা ঘুরছিল না এমন নয় তবে নিজের অবস্থান থেকে একবিন্দু সরে যাওয়া মানে পরাজয়। আমি বীরের মতো এগিয়ে যেতে লাগলাম,কিন্তু কোথায়? অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেলাম পথের ধারে আরেকটি বৌদ্ধ গুম্ফা। ব্যাস। এখানেই রাত্রিযাপন। তিনজনের ব্যাগ থেকে বেরোলো তিনটি ত্রিপল। কিছুক্ষণ কাটল। অদূরে নদী থেকে ভেসে আসছে কুলুকুল। ফুনশিলং এখন নিস্তব্ধ, শান্ত শহর। কয়েকজন পথে যেতে যেতে সেই গুম্ফায় এসে দাঁড়াচ্ছে ,বিস্ময়ের চোখে দেখছে আমাদের। আমার হাবভাব হিপিদের মতো, থোড়াই কেয়ার করছি, ভেতরে ভেতরে কি ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে একটা। সায়ন একটু চিন্তিত, কল্যাণ একটা ভাতঘুম দেবে বলে শরীরটা ফেলে দিয়েছে।
একটি ছেলে এসে কিছুটা বিস্মিত হয়েই আমাকে বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করল। আমি স্মার্ট ইউরোপীয় ধাঁচে ইংরেজি বলে নিজেকে বিরাট পরিব্রাজক প্রমাণ করলুম। তারপর এলো আরেকজন,তারপর আরেকজন। সকলেই পরামর্শ দিল যে রাত্রিবেলা পুলিশের হেনস্থা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের এখুনি ভুটান গেটের রক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিৎ। ওরাই আমাদের থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেবে। বিশেষত একটি ছেলে এত হাসিমুখে ভুটান পুলিশের গুণকীর্তন করলো ভাব এমন যেন আমরা জামাই আদর ছেড়ে এখানে পড়ে থেকে বোকামো করছি।
একটু দ্বিধা সত্ত্বেও আমরা তিনজনে গেলুম রাত সাড়ে এগারোটায় ভুটান গেটের রক্ষিদের কাছে। সেই চোস্ত ইউরোপিয়ান ইংরেজিতে বললুম— কোথায় আমাদের সেই রাজপ্রাসাদ?
নিরস পুলিশ ছিল। সেই সাড়ে এগারোটায় আমাদের ভুটানের বাইরে বার করে দিল জয়গাঁওতে। যারা ভুটান থেকে বেরিয়ে জয়গাঁও দেখেছেন তারা আমার মনের অবস্থা জানেন। কল্যাণ ও সায়ন ততক্ষণে আমাকে বীরের আসন থেকে কোন ভূতলে নামিয়েছি তা স্পষ্ট আন্দাজ করতে পারছি। তবে নেতাদের সঙ্গে এমন একটু আধটু হয়। তা বলে তাকে নেতৃত্ব ছাড়লে হয় না। জয়গাঁও বাস স্ট্যান্ডে অসহ্য মশার কামড় খেতে খেতে নিজের নেতৃত্বের কথাই ভাবছিলুম।পাঁচিল টপকে কয়েকটা কুকুরের সঙ্গে একপ্রস্থ বনিবনা করে যখন সিমেন্টের বসার জায়গায় হাত পা কামড়ে শুয়ে আছি আমার দুজন সৈন্য তখন মশার কামড়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি।শুয়ে শুয়ে ভুটান পাহাড়টাকে দেখি। যে গুম্ফাটায় সন্ধে নামতে দেখলাম সেটি এখান থেকে দেখা যায়। কেমন স্বপ্নের মতো লাগে। ভোর ছটায় বাস চিলাপোতা জঙ্গল থেকে ছুটবে কোচবিহার।
আবার গেছিলাম ভুটানে। সেবার ওই গুম্ফার কাছাকাছি ছেলেটাকে অনেক খুঁজেছি। 

Post a Comment

1 Comments