লকডাউনের বর্ষা
অতনু রায়
বর্ষা এসেছে— সে তো কবেই এসেছে। করোনাকালে এটি আর কোনও বিশেষ ঘটনা নয়। ঋতুচক্রের স্বাভাবিক নিয়মমাত্র। তবে এই ঋতু শিল্পীমনের খুব বড় প্ল্যাটফর্ম। কত কবিতা, গান এই বর্ষাকে নিয়ে। এখন যদিও গৃহবন্দি বর্ষাযাপনে ভরসা বলতে ব্যালকনি অথবা জানালা থেকে বৃষ্টি দেখা। আরও একটি উপায় অবশ্যই আছে, যদিও তাতে বৃষ্টির ছাঁট মাখার সুযোগ নেই। সেটি হল সোশ্যাল মিডিয়ার বর্ষাযাপন। যদিও আমার এই অতি অনাবশ্যক বকবকানি তেমনই এক ই-আয়োজনের জন্যই। সত্যি বলতে কী এই বর্ষায় আমার কোনও উচ্ছ্বাস নেই। বরং একঘেয়ে বৃষ্টি যেমন বিরক্তি উদ্রেক করছে। কোথাও যাওয়ার নেই, কোনও কাজে বাধা সৃষ্টি করছে না, তাও এই বৃষ্টি ভাল লাগছে না। এই যে গুহায়-বন্দি জীবন, বর্ষার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় গুমোট দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
মুক্তির জন্য ছটফট করতে করতে কবিতার কাছে, গানের কাছে নতজানু হয়ে বসি। খুঁজে পাই কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দর সেই আশ্চর্য চরণ- “মেঘৈর্মেদুরম্বরং বনভূ্বশ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ”। সংস্কৃত এই শ্লোকে বর্ষার চিরচেনা ছবি, মেঘে ঢাকা কোমল আকাশ আর শ্যামশোভাময় বন তমালের কী লাবণ্যভরা রূপ! কতকাল আগে কেটে গেছে জয়দেবের কাল— আজও সেই নির্জন বর্ষার ছবিটা তেমনই জীবন্ত! বহুবছরের ওপার থেকে আজও বয়ে আনে— সে যুগের সেই মেঘমেদুর দিন— বর্ষাস্নাত তরুরাজির পেলবতা। আজকের ঘন মেঘে ঢাকা দিনটি গিয়ে মেশে সেই বহুকাল আগের বর্ষার দিনটির সঙ্গে। বর্তমান আর অতীত মিলেমিশে একাকার হয়ে বন্দি জীবনে টাটকা বাতাস বয়ে আনে।
বুঝতে পারি কবিরাই বুঝি পারেন এমন অসাধ্য সাধন! নিবিড় মেঘ আর সজল হাওয়ায় মনে পড়ে মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত। চোখের সামনে ভেসে ওঠে পূর্বমেঘের দৃশ্যপট। রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত যক্ষ। যক্ষের বিরহী প্রাণের বার্তা তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিতে সুদূর অলকায় ভেসে চলেছে আষাঢ়ের মেঘ। মেঘ চলেছে উত্তরের পথে… পথে বিন্ধ্যপর্বত… তার নীচে পাথর-নুড়ির পথ বেয়ে অজস্র ঝর্ণা এসে মিশেছে রেবা নদীতে… প্রস্ফুটিত কেতকীর বেড়া দিয়ে ঘেরা দশার্ণ দেশ… ওপরে ছুটে চলেছে বর্ষার মেঘ- নীচে ছুটে চলেছে বুনো নদী বেত্রবতী… বেত্রবতীর কূলে ঐশ্বর্যময় বিদিশা…। নির্বিন্ধ্যা তটিনী পেরিয়ে অবন্তী নামের দেশ… শিপ্রা নদী তীরে উজ্জয়িনী…। মেঘদূত ভেসে চলেছে প্রাচীন ভারতবর্ষের উত্তরাপথ দিয়ে… অতুলনীয় নৈসর্গিক শোভা আর সমৃদ্ধ সব প্রাচীন নগরীর ওপর দিয়ে— রামগিরি থেকে দূর অলকায়।
কালিদাসের কালও কেটে গিয়েছে বহুদিন। জলভারানত আষাঢ়ের মেঘ আমাদের আজও নিয়ে যায় পূর্বমেঘের সেই পথে— রামগিরি থেকে হিমালয়ে— যে পথে রয়েছে মানস সরোবর। আশ্চর্য সব নদী-পর্বত-বনতল। সে সব নদীর তীরে তীরে বিদিশা-অবন্তী-উজ্জয়িনী…। বর্ষার গহন মেঘ একালের বৃক্ষবিরল ধূসর নগরীকেও সাজিয়ে দেয় সেকালের উজ্জয়িনীর সুষমায়! আর আমি, মুক্তি খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যাই রবীন্দ্রনাথের কাছে। উল্টে পাল্টে দেখি আমার যাবতীয় সঞ্চয়। পেয়ে যাই অবশেষে, আমার প্রাণের আরাম।
এক বর্ষামুখর দিনে, রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর প্রিয় আবাস শিলাইদহে। সেদিন লিখছিলেন ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধ। লেখার মাঝেই স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে চিঠি লিখলেন একটা। ‘‘সমস্ত আকাশ অন্ধকার করে নিবিড় মেঘ জমে এসে বৃষ্টি আরম্ভ হল- আমার নীচের ঘরের চারদিকের শার্সি বন্ধ করে বসে বসে মেঘদূতের উপর প্রবন্ধ লিখছি। প্রবন্ধের উপর আজকের এই নিবিড় বর্ষার দিনের বর্ষণমুখর ঘনান্ধকারটুকু যদি এঁকে রাখতে পারতুম, যদি আমার শিলাইদহের সবুজ ক্ষেতের উপরকার এই শ্যামল আবির্ভাবটিকে পাঠকদের কাছে চিরকালের জিনিস করে রাখতে পারতুম তাহলে কেমন হত! কি অনায়াসেই জল স্থল আকাশের উপর এই নির্জন মাঠের নিভৃত বর্ষার দিনটি। এই কাজকর্ম ছাড়া মেঘে ঢাকা আষাঢ়ের রৌদ্রহীন মধ্যাহ্নটুকু ঘনিয়ে এসেছে। অথচ আমার লেখার মধ্যে তার কোনও চিহ্নই রাখতে পারলুম না। কেউ জানতে পারবে না কোনদিন কোথায় বসে বসে সুদীর্ঘ অবসরের বেলায় – লোকশূন্য বাড়ীতে এই কথাগুলো আমি আপন মনে গাঁথছিলুম।’’
এখনও ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ়’ যখন আসে– স্বাগত জানাই তাঁর গান গেয়ে। ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ তিনিই উপহার দেন আমাদের! ভেজা কদম কেতকীর সুবাসের সঙ্গে স্মৃতিবেদনাও আসে। আমাদের ‘যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে’ সেইসব দিনের ছায়াও পড়ে শ্রাবণ আকাশে। তাই, গহন মেঘে আকাশ ঢেকে ‘মধু গন্ধে ভরা- মৃদু স্নিগ্ধছায়া- নীপ কুঞ্জতলে’ যে বর্ষা আসে- তার অন্যতম অনুষঙ্গ –রবীন্দ্রনাথ।
জলদ তালে ‘অম্বরে মেঘ মৃদঙ্গ বাজতে’ শুনেছিলেন নজরুলও। আশ্চর্য মরমী সুরে শুনিয়েছেন আমাদের ‘শাওন রাতে’ স্মরণে আসা বিরহীর মর্মবেদনা। ঝরো ঝরো বাদল দিনে ‘কদম তমাল বনে’ ঝুলনা বাঁধা অন্য এক জগতের দরজা খুলে যায় নজরুলের সুরের জাদুতে। ‘পরবাসী মেঘের’ সঙ্গে সঙ্গে তাই তিনিও সঙ্গী আমাদের।
হাজার বছর ধরে কবিদের বর্ষাবন্দনায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে বর্ষার মোহিনী রূপ। ব্যক্ত হয়েছে অনেক- অব্যক্ত রয়ে গেছে আরও বেশি। গহন বর্ষার সজল কালো মেঘ-বৃষ্টি ভেজা ভুঁইচাপা, কামিনী আর দোলনচাঁপার গন্ধ মনে যে অনির্বচনীয় আনন্দ সঞ্চারিত করে– ভাষার সাধ্য কি পৌঁছয় সেখানে! মেঘমেদুর বর্ষার রঙ রূপ গন্ধ মানুষ ভালবেসেছে অনন্তকাল ধরে। আর যুগে যুগে কবিরা সে ভালবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন তাঁদের লেখায়- মেঘমল্লারে বেঁধেছেন স্নিগ্ধ বর্ষাবন্দনা। আর এইসবের মাঝেই আমি খুঁজে পাই আমার মুক্তি। এই বছরের বর্ষা আমার মনে প্রভাবশালী হয়নি ঠিকই, কিন্তু বর্ষার চিরকালীন এইসব সৃষ্টি আমাকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। এই গুমোট বন্দি জীবনে আমাকে আশ্রয় দিয়েছে।
11 Comments
Amar to besh nostalgic laglo
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Deleteবেশ ভালো লাগলো
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Deleteদারুণ লিখেছ ভাই ! বর্ষা তোমাকে সরস করে তুলেছে । সুন্দর !
ReplyDeleteধন্যবাদ দাদা
Deleteদারুণ লিখেছ ভাই ! বর্ষা তোমাকে সরস করে তুলেছে । সুন্দর !
ReplyDeleteধন্যবাদ দাদা
DeleteBesh research kore lekha...
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteভালো লেগেছে
ReplyDelete